এবারের ৭৭তম কান উৎসবে ৫০ পেরোনো ঐশ্বরিয়ার কালো-সবুজ কিংবা কালো-সোনালি ঝলমলে গাউনের পাশাপাশি আলোড়ন ফেলেছে তাঁর মুখের বয়সের ছাপ আর প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়টি।
এবারের ৭৭তম কান উৎসবে ৫০ পেরোনো ঐশ্বরিয়ার কালো-সবুজ কিংবা কালো-সোনালি ঝলমলে গাউনের পাশাপাশি আলোড়ন ফেলেছে তাঁর মুখের বয়সের ছাপ আর প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়টি।

মতামত

কেন আমাদের সবচেয়ে সুন্দর আর কম বয়সী দেখাতে হবে!

প্রতিবছর কান চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হলেই তারকাদের পোশাক আর ফ্যাশন-ভাবনা নিয়ে মিডিয়ায় শুরু হয়ে যায় তুলকালাম কাণ্ড। তবে এই আয়োজনে প্রায়ই দেখা যায় তারকারা মিডিয়া ও ভক্তদের মনোযোগ আকর্ষণের সর্বোচ্চ চেষ্টা হিসেবে যে পোশাক কিংবা রূপসজ্জার আশ্রয় নেন, তা রীতিমতো অবাস্তব ও হাস্যকর। এই পোশাকগুলো না দীর্ঘ সময় পরিধানযোগ্য, আর না তা আরামদায়ক। অনেক সময়ই পোশাক আর রূপসজ্জার অস্বস্তি ফুটে ওঠে তাঁদের অভিব্যক্তিতে। তাঁদের মেকি হাসি আর নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের টান টান উত্তেজনা ধরা পড়ে ক্যামেরায়।

তারকা মানেই যেন সাধারণের চেয়ে আলাদা হতেই হবে। আর এই আলাদা হওয়ার প্রয়াসে রূপযৌবন ও জৌলুশের প্রদর্শনকেই বেছে নেন তাঁরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কান চলচ্চিত্র উৎসবের লালগালিচায় নিয়মিত হাঁটছেন সাবেক বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের ৭৭তম কান উৎসবে ৫০ পেরোনো ঐশ্বরিয়ার কালো-সবুজ কিংবা কালো-সোনালি ঝলমলে গাউনের পাশাপাশি আলোড়ন ফেলেছে তাঁর মুখের বয়সের ছাপ আর প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়টি।

সম্প্রতি চেহারায় বয়সের ছাপ নিয়ে তিনি নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হচ্ছেন। কানের লালগালিচায় ৫০–এর দোরগোড়ায় পৌঁছানো ঐশ্বরিয়া রাইকে যেন মেনেই নিতে পারছেন না ভক্তরা। সাবেক এই বিশ্বসুন্দরী নিজেই কি তাঁর বয়সের স্বাভাবিক পরিণতি মেনে নিতে পারছেন? হয়তো পারছেন না বলেই প্লাস্টিক সার্জারির শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। অথচ জীবনপরিক্রমায় চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।

তারকাদের প্রৌঢ়ত্বকে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না ভক্তরা। আর ভক্তের অসন্তুষ্টির মানে হলো কক্ষপথ থেকে তারকার খসে পড়া। তাই তারুণ্য আর জৌলুশ ধরে রাখতে প্রকৃতির সঙ্গে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেন তারকারা। যৌবন ধরে রাখাতে তারকাদের এই যুদ্ধ দেখে কেবলই করুণা হতে থাকে আমার। কারণ, গ্ল্যামার, পোশাক ও মেকআপের জন্য মিলিয়ন ডলার খরচ করেও যে নিখুঁত সুন্দর হওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তারকাদের খুঁত খুঁজে বের করতে উৎসুক কৌতূহলী চোখের কাছে প্রায়ই ধরাশায়ী হতে হয় তাঁদের।

সুন্দর দেখানোর অস্বাস্থ্যকর এই যুদ্ধ আজকাল ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা গেট টুগেদারে আজকাল সাধারণের মধ্যেও দেখি সবচেয়ে সুন্দরভাবে নিজেকে তুলে ধরার প্রস্তুতি। একই সঙ্গে বয়সের বলিরেখাগুলোও ঢেকে রাখা চাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৃষ্ট বন্ধুদের গ্রুপগুলোয় চলে নিজেকে তরুণ হিসেবে উপস্থাপনের বাহুল্য আয়োজন। এ ছাড়া স্মার্টফোনে সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা বয়স কমানোর অ্যাপস তো আছেই। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি সব সময়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই চেষ্টায় প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব অস্বাস্থ্যকর।

প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে হবে? কেন কম বয়সী দেখাতে হবে আমাদের! অনর্থক এই উন্মাদনা আর প্রতিযোগিতা কি আমাদের ব্যক্তিজীবনের শান্তি আর স্থিতি কমিয়ে দিচ্ছে না? সুন্দর হওয়ার এই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। সৌন্দর্যের এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ অকারণে আমাদের অসুন্দর ভাবতে শেখায়। এরপর চলে অসুন্দর থেকে সুন্দর হওয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত। কারণ, সৌন্দর্যের নেই কোনো সর্বজনস্বীকৃতি মানদণ্ড। সৌন্দর্যের বিচার আপেক্ষিক। একজনের কাছে যা সুন্দর, অন্যের বিবেচনায় তা সুন্দর নাও হতে পারে।

সৌন্দর্যের পেছনে ছোটার অর্থ অনেকটা মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই। কখনো কখনো আমাদের স্বপ্নের তারকাদের মেকআপহীন কিংবা জৌলুসহীন যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়, এতে স্পষ্ট হয়, মেকআপহীন তারকারা আমাদের মতোই সাধারণ। তাঁদের মুখেও আছে ব্রণের দাগ কিংবা বলিরেখা। তাঁদের চোখের চারপাশেও থাকতে পারে ক্লান্তির কালো ছাপ, শরীরে জমতে পারে চর্বি কিংবা মাতৃত্বের দাগ। কিন্তু আমরা তারকাদের সাধারণত্ব মানতে নারাজ। ভক্তরা বুঝতে চান না, তারকারাও মানুষ। তাঁরাও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। গ্ল্যামার জগৎটি তাঁদের পেশাগত জগৎ মাত্র। তারকাদের সঙ্গে সাধারণের পার্থক্যটি হলো, তারকারা এমন এক জগতে কাজ করেন, যেখানে তাঁদের ঘিরে থাকে লাইট, ক্যামেরা আর সংবাদমাধ্যম। বিষয়টিকে এভাবে দেখলে তারকাদের গ্ল্যামারকে নিজেদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে অশান্তিতে ভোগার কোনো কারণই জন্ম নেবে না।

মনে পড়ে, ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সোনম কাপুর কোনো এক সাক্ষাৎকারে নারীদের তাঁদের সহজাত সৌন্দর্য নিয়ে সন্তুষ্ট আর আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি তাঁর তারকা সৌন্দর্যের পেছনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন অন্যের সামনে তারকাদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য। কারণ, মেকআপ ছাড়া তাঁরা আর দশজনের মতোই সাধারণ। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রূপসজ্জা, রূপচর্চা, ব্যায়াম আর খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মতো কঠোর অনুশীলনের পরও যে চেহারা নিখুঁত সুন্দর দেখাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেরা ক্যামেরা আর সেরা কৌশলে ছবি তোলার পরও প্রায়ই ফটোশপের কারসাজিতে তাঁদের সৌন্দর্যের দেবী হয়ে উঠতে হয়। তাই তিনি প্রতিটি পরিবারের প্রতি আকুতি জানিয়েছিলেন, বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং তাঁরা যেন তাঁদের সন্তানদের, বিশেষত কন্যাসন্তানদের আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার শিক্ষা দেন। আর এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি হলো শিক্ষা, যোগ্যতা আর মনের সৌন্দর্য।

বিলবোর্ডে দেখা তারকার সৌন্দর্য প্রকৃত সৌন্দর্য নয়; বরং প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের যে ছবি দেখি, সেটিই প্রকৃত সুন্দর। কারণ, সেই প্রতিবিম্বে ফুটে ওঠা সৌন্দর্য বাস্তব, নির্ভেজাল ও খাঁটি। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে যাঁরা হীনম্মন্যতায় ভোগেন, তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনি সুন্দর। সুন্দর আপনার মুখশ্রী। বয়সের পরিক্রমায় জন্ম নেওয়া আপনার মুখের প্রতিটি বলিরেখা সুন্দর। সুন্দর আপনার চোখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়া বয়সের ছাপ, মুখের বাদামি তিল কিংবা মেছতার দাগ। তাই আসুন, আমরা সৌন্দর্যের মরীচিকার পেছনে না ছুটে নিজের সত্যকে সুন্দর হিসেবে গ্রহণ করতে শিখি এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। কেননা, যা আপনার সত্য, তা–ই সুন্দর।

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী