রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড
রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড

নিরাপত্তাহীন রেস্তোরাঁ যখন মৃত্যুকূপ

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার ও সাততলা থেকে বেশ কয়েকজন উদ্ধারের খবর স্বস্তি ও আশ্বস্ততা তৈরি করেছিল। সকালে ঘুম থেকে জেগে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ জনের মৃত্যুর খবর ছিল বিশাল এক ধাক্কা। মর্মান্তিক এই ট্র্যাজেডি একটা গা হিম করা অসহায়ত্বের অনুভূতি জাগাচ্ছে। উদ্ধার করা হয় আরও অর্ধশতাধিক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তিদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের অনেকের শ্বাসনালি পুড়েছে। রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক তার এক সহকর্মীর মেয়ের মৃত্যুর দিয়ে আর যেন মৃতের সংখ্যা না বাড়ে সেই প্রার্থনা করতে বলেন।

বেইলি রোডে যে ভবনটিতে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সেখানে দুই তলা ও চার তলার দুটি রেস্টুরেন্টে বেশ কয়েকবার স্বজন ও বন্ধুদের নিয়ে খেতে গেছি। তাই এই ঘটনার পর বারবার মনে হচ্ছে, আমরাও তো হতে পারতাম এই নির্মম ট্র্যাজেডির বলি। এ দুটি তালাতেই একাধিক রেস্টুরেন্ট। কাচঘেরা ভবন। কোনার টেবিলগুলোতে বসলে রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়। কে না জানে, আগুন লাগলে কাচের ভবন দ্রুত আগ্নেয়গিরি হয়ে ওঠে। বাতাস বের হতে না পারায় আগুন ও ধোয়া নিমেষেই উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাচঘেরা একেকটা বহুতল ভবন যেন একেকটা মৃত্যুকূপ।

বেইলি রোডের রাস্তা প্রশস্ত। আগুন লাগার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারে। তারপরও কেন এত হতাহত? প্রাথমিক খবরে যা জানা যাচ্ছে, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অসংখ্য মানুষের হতাহত হওয়ার সব ‘ব্যবস্থা’ সেখানে করাই ছিল। একে তো কাচঘেরা ভবন তারপর সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। আগুন লাগার পর সিলিন্ডার  বিস্ফোরণ হওয়ায় উপরে ওঠার কিংবা বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না।

আমি বিশেষজ্ঞ নয়। কিন্তু ভবনটিতে কয়েকবার যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, সাততলা ভবনটির নিচতলা বাদে উপরের তলাগুলোর ভেতরের নকশা কোনোভাবেই বাণিজ্যিক কাজের উপযুক্ত নয়। বেইলি রোডে রেস্তোরাঁ ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠায় ভবনটিকে রেস্তোরাঁর কাছেই ব্যবসার জন্য ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। হতে পারে রেস্তোরাঁর জন্য আলাদাভাবে নির্মিত নয় ভবনটি। বিষয়টি কি কখনো তদারকি করা হয়েছিল? সেখানে কি কখনো অগ্নি দুর্ঘটনার মহড়া হয়েছিল? আসলে ঢাকা শহরে বহুতল ভবনগুলোতে এমন মহড়া কয়টা হয়? এই সব অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর তদারকিহীনতা যে ভয়াবহ হতে পারে, তা আবারও আমরা দেখলাম বেইলি রোডে।

রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই মানুষগুলোর জন্য কোথাও কোনো খোলা জনপরিসর নেই। কোথাও কারো সঙ্গে দেখা করে দুটো কথা বলার জায়গা নেই। ঢাকার মানুষ তাহলে কোথায় যাবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেস্তোরাঁ শিল্পের বিকাশ হওয়ার পেছনে এটা একটা অন্যতম কারণ। গোছালো পরিবেশে কিছুটা সময় বন্ধু, পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার, আড্ডা দেওয়ার, কথা বলার বা গেট টুগেদারের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। আবার অনেকের আর্থিক সামর্থ্য কিংবা ব্যয় করার অভ্যস্ততা পরিবর্তন হওয়ায় নতুন ধরনের রেস্তোরাঁর শিল্প দ্রুত বিকাশ হচ্ছে।

বেইলি রোড, খিলগাঁও, সাত মসজিদ রোড, ধানমন্ডি, বনানী এখন রেস্টুরেন্ট হাব। এ সব এলাকার একেকটা ভবনের প্রায় পুরোটা জুড়ে রেস্টুরেন্ট। কিন্তু রেস্টুরেন্ট করার উদ্দেশ্য থেকে এ সব ভবন তৈরি করা হয়েছি কি? আবাসিক ভবনে দিব্যি রেস্টুরেন্ট চলছে। আমরা সবাই সেখানে যাচ্ছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। সুন্দর করে সাজানো গোছানো সব রেস্টুরেন্ট। সুবেশী সব কর্মী। ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে আন্তরিকভাবে তারা কথা বলেন। এত এত আয়োজন, কোথাও কোনো কৃপণতা নেই। তার মাঝে শুধু মানুষের নিরাপত্তারই কোনো আয়োজন নেই। সেখানেই সবটা কৃপণতা।

আমাদের নাগরিকদের জীবন প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পুড়ে কয়লা হতে কিংবা ধোয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায়। কারো যদি কোনো দায়িত্বপালন না থাকে তাহলে ৪৩ জনের মৃত্যুর পর আর যেন মৃতের সংখ্যা না বাড়ে সেই প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী