সংবাদ প্রকাশের জেরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাংবাদিককে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বলছে, তাদের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের বক্তব্য খণ্ডায়ন করে যে প্রতিবেদন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে এসেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত শৃঙ্খলা আইনের বলয়ে ইকবাল মনোয়ার নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাংবাদিককে বহিষ্কারের আদেশ জারি করা হয়।
এ ধরনের বহিষ্কার নতুন নয়। যুগে যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ঘটনা ঘটে আসছে। সাড়ে পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এসব ক্ষমতাচর্চা দেখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশে যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা সম্প্রদায় হলো বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকেরা। এখানকার একজন সাংবাদিক পরিচয়ের আগে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরা সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাস-পরীক্ষায় যেমন অংশ নেন, তেমনি পেশাদারির জায়গায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচকানাচে ঘটে যাওয়া সংবাদ জাতির সামনে তুলে আনেন।
আপনি যখন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবেন, তখন আপনার সামনে হুমকি, ছাত্রত্ব হারানো, হামলার শঙ্কা প্রকট হয়। যাঁরা কেবল সাংবাদিকতা করতে চান, তাঁরা নানামুখী বাধার শিকার হন। তাঁদের মাথার সামনে সব সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা নিজ বিভাগের শিক্ষকদের বল প্রয়োগের ছড়ি ঘুরতেই থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসে বাস্তবিক পেশাদারির অভিজ্ঞতায় পা ফেলানো শিক্ষার্থীদের নির্ভীক সাংবাদিকতায় বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এসব। এরপরও কিছু শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লেখালেখি করছেন। পড়াশোনা চলাকালীন যে অভিজ্ঞতা হয়, তা কাজে লাগিয়ে তাঁরাই একসময় বাংলাদেশের মূলধারা সংবাদপত্রে বেশ দায়িত্বশীল ও পেশাদারির পরিচয় বহন করে আসছেন। বলা যেতে পারে, দেশের যাঁরা সাংবাদিকতায় ভালো করছেন, তাঁদের একটি বড় অংশের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয় বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায়।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়, ভবিষ্যৎ জাতি বিনির্মাণের সিঁড়ি। এখান থেকেই দেশের পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরি হয়, যাঁদের দায়িত্ব থাকে দেশটাকে এগিয়ে নেওয়া। ফলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক দায়িত্ব হলো, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে দেশ ও সমাজের দায়িত্ব গ্রহণের উপযোগী হিসেবে তৈরি করা। প্রশ্ন করার ক্ষমতায় যেন শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা তৈরি হয়, তা নিশ্চিত করা। আপনি যখন আপনার শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, তখন নিঃসন্দেহে সেটি জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আপনি যে আচরণ আপনার ছেলেমেয়েতুল্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করবেন, সেটিই পরবর্তীকালে তাঁরা কর্মজীবনে প্রতিফলন করাবেন। সুতরাং একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিক কোন পথে হাঁটবে, তা নির্ণয় করার দায়িত্ব শিক্ষকদের রয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঠিক কোন কথার পরিপ্রেক্ষিতে ‘বুলেটগতিতে’ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারাদেশ প্রদান করলেন, তা একটু জেনে নেওয়া যাক।
খবরটি জানার পর মাননীয় উপাচার্যের অডিও ক্লিপটি হাতে পেলাম। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়টির এক বিভাগের নবাগত শিক্ষার্থীদের বরণ ও বিদায়ী অনুষ্ঠানে গত ৩১ জুলাই গিয়ে দেওয়া বক্তব্য সেটি। ২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপটির কণ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের বলেই সেখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আমাকে নিশ্চিত করেছেন। শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য দেওয়ার ওই অডিওতে উপাচার্য বলছিলেন, ‘একজন আমাকে এসে বলছিল, স্যার এই দেশে দুর্নীতির কারণে উন্নতি হচ্ছে না। আমি তাকে বললাম, উল্টোটা বলো না কেন? এই দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে।’ যদিও তিনি বলছেন, ওই ব্যক্তির সূক্ষ্ম বিচারবিশ্লেষণের ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য তিনি এ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তবে পরবর্তীকালে তিনি যা বলেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়ার শামিল।
দুর্নীতি কীভাবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, তার যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে এই অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের সামনে বলছিলেন, ‘দুর্নীতির কারণে এখন সবার পকেটে টাকা, সবার মা–বাবা ঘুষ খায়। কিন্তু এই ঘুষ খায় বলে কী হয় জানো, এই ঘুষের টাকা আছে বলেই দৌড়ে যায় পদ্মার পাড়ে ইলিশ খেতে। পদ্মা পাড়ের গরিব মানুষেরা সেখানে দোকান দিয়েছে, যা বিক্রি করে তাদের পেটে ভাত জুটছে। ইকোনমিক মেশিনারিজ আর অল ফাংশনাল কারণ আমাদের কাছে পয়সা আছে। পয়সাটা আসছে কোথা থেকে? ঘুষ থেকে।’
সারা বিশ্বে দুর্নীতিকে নিরুৎসাহ দেওয়া হয়। যেসব দেশে বা রাষ্ট্র দুর্নীতির কবলে পড়ছে, তাদের অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের নজির অহরহ রয়েছে। নিজ দেশের দুর্নীতির পীড়াপীড়িতে অসুবিধাবোধ না করলেও বেশি দূর যেতে হবে না, শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালেই যথেষ্ট।
এ পর্যন্ত বক্তব্য দিয়ে তিনি হয়তো শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিসের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। তবে তিনি এর পরবর্তীকালে যে কথাগুলো বলেছেন, তা বিতর্কিত এবং দেশের প্রচলিত রাষ্ট্রের সংবিধান পরিপন্থী বটে। উপাচার্য দুর্নীতির মধ্য দিয়ে উন্নয়নের যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে বলে ফেলছেন, ‘ইকোনমিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেয়ারস লজিক।’ মানে দুর্নীতি করা অর্থনীতির দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত। আর সেই কারণে অর্থনীতিবিদেরা দুর্নীতির বিপক্ষে তেমন কথা বলেন না। তাঁর ভাষ্য, ‘ইফ ইউ সে দ্যাট করাপশন অ্যাকচুয়ালি ব্লকস দ্য ডেভেলপমেন্ট, দ্যাটস নট ট্রু।’
এসব শোনার পর মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সূক্ষ্ম চিন্তাশীল হওয়ার উদাহরণ টানতে গিয়ে তিনি যে বিষয়টি আলোকপাত করেছেন, তা স্রেফ ‘কুযুক্তি’ এবং দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাননীয় উপাচার্য আপনি কি বলবেন, পৃথিবীর কোন অর্থনীতির শাস্ত্র দুর্নীতিকে অর্থনীতির পার্ট হিসেবে দেখছে? পৃথিবীর কোন অর্থনৈতিক দেশ দুর্নীতিকে গ্রহণ করতে তাদের সংবিধানে সংযুক্ত করেছে?
নিজ দেশ দুর্নীতিতে পর পর চ্যাম্পিয়ন হয়, সে প্রসঙ্গ না টেনে চীনকে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র আখ্যা দেওয়ার যুক্তি কেন? চীনের উন্নতি হচ্ছে কেন, সেটির দিকেই তো আমাদের মনোযোগ বেশি হওয়ার কথা। আর চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার মাপকাঠি আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার মাপকাঠি পরিমাপ করলে বোঝা যায়, দুর্নীতি কীভাবে ক্ষমতায়ন করে। সেখানকার শিক্ষকদের পদোন্নতির মাপকাঠিতে চোখ বুলিয়ে নিলে চোখে পড়বে শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান।
সারা বিশ্বে দুর্নীতিকে নিরুৎসাহ দেওয়া হয়। যেসব দেশে বা রাষ্ট্র দুর্নীতির কবলে পড়ছে, তাদের অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের নজির অহরহ রয়েছে। নিজ দেশের দুর্নীতির পীড়াপীড়িতে অসুবিধাবোধ না করলেও বেশি দূর যেতে হবে না, শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালেই যথেষ্ট।
দুর্নীতি অর্থনীতিকে কেমন করে নষ্ট করে, কেমন করে দারিদ্র্য তৈরি করে তা আপনার কাছে অনুমেয় হবে না। মাননীয় উপাচার্য, যে পদ্মার পাড়ে ইলিশ খাওয়ার গল্প শিক্ষার্থীদের শোনালেন, সেই পদ্মার পাড়ের রেস্তোরাঁর একটি বড় অংশই তো আপনার–আমার মানুষদের হাতে তৈরি। এটি তো কোনোভাবে বলা যায় না যে, দুর্নীতি করছে বিধায় ফুটপাতের ভাতের দোকানে গিয়ে দুর্নীতিবাজরা ভাত খায়, ফলে ফুটপাতের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। এমন ইকোনমিক্যাল থিওরি তো দেওয়া সম্ভব নয়, তা–ই নয় কি?
শিক্ষার্থীদের মন–মগজে কোন বিষয়টি নিয়ে সূক্ষ্ম চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে, তা বোঝার সক্ষমতা প্রত্যেক শিক্ষকের হওয়া চাই। ডিনামাইট আবিষ্কার করে আলফ্রেড নোবেল ‘অস্ত্রবাজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন নাকি ডিনামাইটের ব্যবহারে মানুষের উপকারের অর্থে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত করবেন, তার যুক্তি খণ্ডনের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক দুর্নীতিতে অর্থনীতির সুদিন হয়, এমন উদ্ভট কথাবার্তায় নিজের অবস্থানটা শিক্ষার্থীদের সামনে খুব একটা ভালো হবে না, এটাই স্বাভাবিক।
অর্থনীতির সুস্বাস্থ্য পেতে হলে দুর্নীতি কেন যে শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারাদেশ দেওয়া হয়েছে, সেই ক্ষমতাচর্চার কোনো স্থান নেই একজন উপাচার্যের। এটি চালু থাকলে অর্থনীতি কতটা পর্যুদস্ত হয়, সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার চিন্তাশীল মানসিকতাও থাকা চাই।
তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাও শিক্ষকসুলভ হয়নি বলে মনে করি। আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, একজন সাংবাদিক আর শিক্ষার্থীর পরিচয় এক নয়। ক্লাসে, পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীর বড় পরিচয় সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর যখন সাংবাদিকতার পরিচয় বহন করবে, তখন তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেশের আর দশটি সাংবাদিকদের মতোই হতে হবে।
আজকে ইকবাল মনোয়ার যে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বহিষ্কার হয়েছেন, সেই প্রতিবেদনটি যদি কুমিল্লা শহরের কোনো সাংবাদিক করতেন কিংবা ঢাকার কোনো সাংবাদিক করতেন, তাহলে কি এমন পদক্ষেপ নেওয়া যেত? তাঁকে কীভাবে বহিষ্কার করার এখতিয়ার হতো তখন?
সবাই ভুল করে। ভুলের ঊর্ধ্বে কেউ নন। সাংবাদিক ভুল করলে, সংক্ষুব্ধ হলে পত্রিকায় প্রতিবাদলিপি পাঠানো যেত। সংবাদ সম্মেলনে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা যেত, প্রয়োজনে প্রেস কাউন্সিলেও যাওয়া যেত, সেটিও না হলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যেত। এসব না করে একজন শিক্ষার্থীকে এমন বহিষ্কারাদেশ অটোক্রেটিক মনোভাবের ফসল বৈকি।
যে গতিতে একজন সাংবাদিককে হেনস্তা করা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। এটি বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, প্রক্টোরিয়াল কার্যাদেশে নেই। তাহলে কোন আইনে করা হয়েছে?
আমরা চাই, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করুন। দ্রুত সাংবাদিক ইকবাল মনোয়ারের বহিষ্কারদেশ প্রত্যাহার করা হোক।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com