মতামত

বর্তমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন কতটা সম্ভব

প্রায় ৩৩ বছর আগে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত ‘তিন জোটের রূপরেখা’য় বলা হয়েছিল, ‘এই সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত অতীতের প্রতিটি নির্বাচনে ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, এমনকি নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং অবশেষে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ঘোষণার নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের অব্যাহত প্রক্রিয়া চলে আসছে। এ অবস্থায় এই সরকারের অধীন কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’ মনে হতে পারে, এটা বর্তমান সময়ের কোনো প্রচারপত্রের বক্তব্য।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আট দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দল এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ দলের পক্ষ থেকে আন্দোলনের মূল দাবি ও লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধভাবে এই রূপরেখা প্রকাশ করা হয়েছিল।

তিন জোটের রূপরেখার মূল দাবি ও লক্ষ্য হিসেবে ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন; রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা; নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা; জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা।

তিন দশকের বেশি সময় পার করে এসে এসব দাবি ও লক্ষ্যের কোনোটা কি বাস্তবায়িত হয়েছে? এর কারণ কি পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ব্যর্থতা বা আদর্শগত সংকট? নাকি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে যে ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন, তিন জোটের রূপরেখায় তা পুরোপুরি ধারণ করা যায়নি? নাকি উভয়ই?

প্রথমত, গত তিন দশকে বাংলাদেশ শাসন করা রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেছে, তাদের স্বার্থের সঙ্গে এসব গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার মৌলিক বিরোধ রয়েছে।

এ দেশের ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে অনিয়ম করে সমৃদ্ধিশালী হওয়া বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরশীলতার। এদের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন খুবই বিপজ্জনক। এ কারণেই জনদাবির মুখে বিভিন্ন সময় তারা এসব বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে এগুলো বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেনি।

দ্বিতীয়ত, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র-মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিও ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে আন্দোলন ‘এক দফা এক দাবি’তে রূপান্তরিত হয়ে সেগুলো মনোযোগ থেকে হারিয়ে গেল। তা ছাড়া রূপরেখায় স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতায় ফেরার আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেলেও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, যেমন সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার অবসান কিংবা সংসদ সদস্যদের দলীয় আনুগত্যে বাধ্য করার ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার ইত্যাদি কোনো গুরুত্ব পায়নি।

ফলস্বরূপ একটা সামরিক স্বৈরশাসকের পতন হলো ঠিকই; রূপরেখায় উল্লেখিত ‘স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি’ কায়েম হলো না; বরং কালক্রমে নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদের জন্ম দিল।

এখন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ধরনের নির্বাচনী আয়োজন থাকে, আনুষ্ঠানিকভাবে তার সবই আছে—নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইনকানুন, ভোটার তালিকা। নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচনে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাও রক্ষিত হয়। কিন্তু নেই সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা; ন্যূনতম গণতান্ত্রিক জবাবদিহি। এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় না, কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে এসব কর্মসূচি পালন করার পথে সব ধরনের বাধা তৈরি করা হয়। তার জন্য ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানাভাবে কাজে লাগানো হয়।

সারা বছর ধরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি সামনে রেখে চালানো হয় বিশেষ অভিযান। সময়-সময় বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সংগঠকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হয়, এলাকাছাড়া করা হয় যেন তাঁরা স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে না পারে। পুরোনো, ভুয়া ও গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হয়।

বিরোধী দলের ঘোষিত সমাবেশস্থলে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের আসার পথে নানাভাবে বাধা তৈরি করা হয়। সমাবেশস্থল অভিমুখী মহাসড়ক ও প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশিচৌকি বসানো হয়। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের শনাক্ত করার জন্য যাত্রীদের মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়। সরকারি সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকা পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা আগে থেকে যেন সমাবেশস্থলের কাছাকাছি এসে অবস্থান নিতে না পারে, সে জন্য আশপাশের মেস, হোটেল ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংগঠকদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়।

যে সরকার এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এভাবে সারা বছর ধরে গণতন্ত্রবিরোধী তৎপরতা চালায়, সেই সরকারের অধীন নির্বাচনের দিন নিরপেক্ষতা আশা করা অর্থহীন।

ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হলে যে ধরনের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন, বাংলাদেশে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। দেশের জনপ্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এমন দলীয়করণ হয়েছে যে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ধরনের সংস্কারের আগে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন কোনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।

যেসব দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিপক্বতা রয়েছে, স্বাধীনভাবে কাজ করার যে কাঠামো রয়েছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আগে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু কি সম্ভব?

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিকঠাক করার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে কী পরিণাম হতে পারে, তা গত দুটি জাতীয় নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এর পুনরাবৃত্তি দেশের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

    kallol_mustafa@yahoo.com