উইকিপিডিয়ায় উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে একজন বাংলাদেশি রাজনীতিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এর তথ্য অনুযায়ী, তিনি মোট পাঁচবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন কুমিল্লা-১ আসনে ((ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হয় আশির দশকে) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন উকিল আবদুস সাত্তার। এরপর বিএনপিতে যোগ দিয়ে তিনি পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটি বিএনপি জোট সঙ্গী মুফতি ফজলুল হক আমিনকে ছেড়ে দেওয়ায় উকিল আবদুস সাত্তার সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিএনপি সরকার তাঁকে টেকনোক্র্যাট কোটায় আইন, মৎস্য ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আবারও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন।
এতে প্রমাণিত হয়, উকিল আবদুস সাত্তার আগাগোড়া বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেই ছিলেন। এমনকি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তিনি ১১ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগও করেন। প্রলোভনে হোক কিংবা ভবিষ্যতে বিএনপির মনোনয়ন না পাওয়ার শঙ্কা থেকে হোক, পরে তিনি উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। বিএনপির নেতৃত্ব আবদুস সাত্তারকে দলীয় আদর্শের পরিপন্থী কাজের জন্য বহিষ্কার করেনি। বহিষ্কার করেছে ‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ দায়ে। অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করেছেন। পরে দল ফিরিয়েও নিয়েছে। গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারী নেতা-কর্মীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই দল থেকে কাউকে বহিষ্কার করলেই বলা যাবে না যে তিনি দলের আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়েছেন। অন্তত সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপিতে থাকা উকিল আবদুস সাত্তারের ক্ষেত্রে তো নয়ই।
২০২৪ সালে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মধ্য পর্যায়ের নেতারা হরদম দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে আসছেন। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ উপনির্বাচনের উকিল মডেল ব্যবহার করতে পারে। যেসব আসনে তারা বিরোধী দল বা বিপক্ষের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে চায়, সেসব আসনে এই মডেল চালু করলে নির্বাচন কমিশনও ‘পক্ষপাতের দায়’ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
উকিল আবদুস সাত্তারের মতো একজন খাঁটি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতিকের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যে ‘মহত্ত্ব ও উদারতা’ দেখিয়েছেন , তা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লেখা থাকবে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলেও আমরা বিএনপির দুই সংসদ সদস্যকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী করেছিলেন জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের নামে। এবারে দলের তিন স্থানীয় নেতাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বসিয়ে দিল বিএনপির সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীকে সংসদে নিয়ে আসার কৌশল হিসেবে। একে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের উকিল মডেল হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন। শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের নেতৃত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে তাঁরা নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। তিনজন সরে যাওয়ায় এই নির্বাচনে বর্তমানে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াসহ পাঁচজন প্রার্থী আছেন।
উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে উপনির্বাচনে জিতিয়ে আনতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া দলের তিন নেতাকে তাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বলে। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা তিনজন হলেন—জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মঈন উদ্দিন, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের নেতা অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম। এই আসনের উপনির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। ১৫ জানুয়ারি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এখন পর্যন্ত এই উপনির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াসহ পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় উকিল আবদুস সাত্তারের জয়ের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। উপনির্বাচনের অন্য প্রার্থীরা হলেন—জাতীয় পার্টির দুইবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা, দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী, আশুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ এবং জাকের পার্টির প্রার্থী জহিরুল ইসলাম। দলীয় কিছু লোকের বিরোধিতার কারণে মঈন উদ্দিন সামান্য ভোটের ব্যবধানে গত নির্বাচনে পরাজিত হন। বিএনপির দলীয় প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ৮৩ হাজার ৯৯৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মঈন উদ্দিন পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ৪১৯ ভোট।
পদত্যাগের আগপর্যন্ত উকিল আবদুস সাত্তার বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। দল ক্ষমতায় থাকতে পাঁচ বছর (২০০১-০৬) মন্ত্রিত্বও করেছেন। বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি আইন। ইনডেমনিটি আইনের সময় উকিল আবদুস সাত্তার স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন। সে জন্য ইনডেমনিটির দায় তাঁর না–ও থাকতে পারে। কিন্তু একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সময় যিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তিনি তাঁর নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় এড়াবেন কীভাবে?
আওয়ামী লীগ নেতারা যে এত দিন বিএনপির সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ করে আসছিলেন, সেটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন? যদি ভিত্তিহীন না হয়, তাহলে সেই সময়ে মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে কীভাবে আওয়ামী লীগ জিতিয়ে আনার জন্য দলের তিন নেতাকে ‘কোরবানি’ দিল? একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার হয়েছে, অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন। সে বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। কিন্তু যখন আওয়ামী লীগ একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার জন্য পুরো দলকে দায়ী করে, তখন সেই দায় থেকে বিএনপি সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীকে কীভাবে ‘ইনডেমনিটি’ দিল?
রাজনীতিতে শেষ কথা নেই বলে যে প্রবাদ আছে, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগ সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করল? একজন উকিল আবদুস সাত্তারকে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজের রাজনৈতিক ও নীতিগত অবস্থানকে কোথায় নিয়ে গেল!
প্রথম আলোর বিশ্লেষণ বলছে, পাঁচটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে উকিল আবদুস সাত্তারের পক্ষ নিয়েছে আওয়ামী লীগ—১. বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ করা ভুল, এটা প্রমাণ করা, ২. উকিল আবদুস সাত্তারের মতো প্রবীণ নেতাকে এভাবে ভোটে এনে বিএনপির ঐক্য ও সংহতিতে ভাঙন দেখানো, ৩. কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি ভোট বর্জনের কথা বললেও মাঠের নেতারা ভোটে অংশ নেওয়ার পক্ষে, এটা দেখানো, ৪. আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপির জন্য কী অপেক্ষা করছে, এই বার্তা দেওয়া এবং ৫. দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টিকেও বোঝানো যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ নেই।
তাহলে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে এত দিন যে রাজনৈতিক ও আদর্শের ফারাক আছে বলে প্রচার করছিল, তা পুরোপুরি অন্তঃসারশূন্য। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে যদি বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী এই ছাড় পেতে পারেন, তাহলে বিএনপির অন্য নেতারা নয় কেন? বিশেষ করে বিএনপির যেসব নেতা ওই সময় সরকার বা দলের নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন না।
২০২৪ সালে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মধ্য পর্যায়ের নেতারা হরদম দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে আসছেন। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ উপনির্বাচনের উকিল মডেল ব্যবহার করতে পারে। যেসব আসনে তাঁরা বিরোধী দল বা বিপক্ষের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে চান, সেসব আসনে এই মডেল চালু করলে নির্বাচন কমিশনও ‘পক্ষপাতের দায়’ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com