দক্ষিণে রেল যোগাযোগ ও বিস্মৃত এক রেললাইনের গল্প

এই রেল ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা, এরপর সেখান থেকে নড়াইল হয়ে যশোর যাবে
ছবি: প্রথম আলো

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রেল যোগাযোগের নবদিগন্ত সূচনার এই সময়ে প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের শোনাব সাধারণের মানস থেকে মুছে যাওয়া শতাব্দীপ্রাচীন এক রেললাইনের গল্প। যে রেলের প্রতিটি চাকার সঙ্গে, প্রতিটি স্লিপারের সঙ্গে মিশে আছে জীবনের বিপুল কথকতা। রেললাইনটির সঙ্গে তৈরি হওয়া সাধারণ মানুষের জীবনবোধ, তাদের একান্ত আনন্দ আর প্রাপ্তিকে বিবেচনায় না নিয়ে কেবল ‘লসের’ অজুহাত দিয়ে কলমের এক খোঁচায় তাকে হত্যা করার কাহিনি আমরা অনেকে ভুলে গেছি, আবার অনেকে ভুলিওনি। রঙিন, সমৃদ্ধ অতীতকে কে ভুলতে পারে! এখন সময় এসেছে আবার ইতিহাসের দাবিকে সামনে আনার, দায় পরিশোধের। তা থেকে আমরা পিছপা হতে পারি না।

পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের কাজ চলছে। স্বস্তির সড়ক যোগাযোগের পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে রেলগাড়ি। পথ কমবে, মানুষের সময় বাঁচবে, জীবনের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই রেল ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা, এরপর সেখান থেকে নড়াইল হয়ে যশোর যাবে।

যশোর থেকে খুলনা পর্যন্ত পুরোনো রেলপথ রয়েছে। খুলনা থেকে বাগেরহাটের মোংলা বন্দর পর্যন্ত চলছে রেললাইন স্থাপনের কাজ। এ রেললাইন প্রধানত ভারতের সঙ্গে কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য। এদিকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকার আরও কাছে এসেছে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা। সড়কপথে এক, দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা থেকে এই দুই জেলায় যাওয়া-আসা করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে জাজিরা থেকে শরীয়তপুর রেল সংযোগ স্থাপিত হবে এমন আলোচনা রয়েছে। অন্যদিকে গোপালগঞ্জে রেল পৌঁছে গেছে ২০১৮ সালেই। ওই বছরের ১ নভেম্বর থেকে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি প্রতিদিন রাজশাহী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ রুটে যাতায়াত শুরু করেছে।

কেবল বরিশাল বিভাগ রেল যোগাযোগের বাইরে রয়েছে। ভবিষ্যতে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরকে ঘিরে মাদারীপুর ছুঁয়ে সেখানেও রেললাইন পৌঁছে যাবে, এমন আশাবাদ সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় দেওয়া হয়েছে। সব মিলে আশাব্যঞ্জক এক ভবিষ্যতের চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন দৃশ্যত রেল যোগাযোগের বাইরে থাকার ঝুঁকিতে পড়ে গেল কেবল বাগেরহাট জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। আর এখান থেকেই আমাদের গল্পের শুরু। এ গল্প শুরু করার আগে আমাদের টান দিয়ে বের করতে হবে ইতিহাসের খেরো খাতা।

২.

ব্রিটিশরাজ এ অঞ্চলে রেলের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। বাংলা অঞ্চলে প্রথম রেল চালু হয় ১৮৫৪ সালে, হাওড়া-হুগলি রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে। আর বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ প্রথমবারের মতো রেলের কু…ঝিক ঝিক ডাক শুনতে পায়, আরও আট বছর পর। সেটা ছিল দর্শনা-জাগতি রেলপথ। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ব্রিটিশ শাসকেরা চেয়েছিলেন তৎকালীন রাজধানী কলকাতার সঙ্গে পূর্ববঙ্গকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে। সে চিন্তা থেকে নির্মাণ করা হয় শিয়ালদহ-রানাঘাট-গোয়ালন্দ রেলপথ। তৎকালে বহু রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক এই রেলপথে চড়েই পূর্ববঙ্গে এসেছেন।

ইতিহাসের নথি থেকে জানা যাচ্ছে, মহকুমা থেকে খুলনা জেলা হিসেবে উন্নীত হয় ১৮৮২ সালে, চব্বিশ পরগনা ও যশোর ভেঙে। খুলনা তখন সমৃদ্ধ এক জনপদ। মাছ, মধু ও গোলপাতার অফুরন্ত উৎস সুন্দরবন। এই সুন্দরবনকেন্দ্রিক অর্থনীতি, পুরোনো নদীবন্দর ঘিরে বেড়ে গিয়েছিল খুলনা জেলার গুরুত্ব। কলকাতার সঙ্গে খুলনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বছরই চালু হলো শিয়ালদহ-যশোর-খুলনা রেলপথ। খুলনা পর্যন্ত রেল চালু হওয়ায় প্রাচ্যের ভেনিসখ্যাত বরিশালের সঙ্গেও কলকাতার একধরনের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই যোগাযোগকে আরেকটু সহজ করতে রেললাইন সম্প্রসারিত করা হয় বাগেরহাট পর্যন্ত। দক্ষিণ জনপদের চেনা মুখ, একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও লেখক অমিত রায় চৌধুরীর এক নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯১৮ সালের ১০ জুন এ পথে ট্রেন চলতে শুরু করে। খুলনা শহরের প্রান্তে পূর্ব রূপসা ঘাট থেকে এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৩২ কিলোমিটার, আর রেলস্টেশন ছিল ১০টি।

৭৮ বছর টিকে ছিল এই রেললাইন। কত লক্ষ, কোটি মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে এই রেললাইন। ভোরের আলোয় যাত্রা শুরু করে ক্লান্ত চেহারা লুকিয়েছে সন্ধ্যার আঁধারে। আমার নিজেরও কত স্মৃতি রয়েছে ন্যারোগেজ রেলপথের ট্রেনটির সঙ্গে। বাড়ি থেকে শুনতে পেতাম ট্রেনটির ডাক। রূপসা থেকে মূলঘর স্টেশনে (ফকিরহাট) এসে ট্রেন যেন ডাক দিয়ে বলত, ‘এসো, আমার পিঠে সওয়ার হও।’ বার্ষিক পরীক্ষার পর শীতের সকালে মামাবাড়ি যাওয়া, পিসি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের দুই বছর, খুলনা থেকে বাড়ি ফেরা, খুলনায় যাওয়া—কত আনন্দমুখর স্মৃতি।

যাঁরা সরকারি-বেসরকারি চাকরি করতে বাগেরহাট যেতেন, এটি ছিল তাঁদের অবধারিত বাহন। যে দরিদ্র মানুষ, শাক-লতা-পাতা, আনাজপাতি নিয়ে খুলনা-বাগেরহাট শহরে যেতেন, তাঁরা এই রেলপথ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতেন না। কারণ, এই রেলপথে গেলেই তাঁরা দুটো পয়সা বাঁচাতে পারতেন। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক চাকরিজীবীকে দেখেছি, টিকিট না কেটে কামরা দখল করে তাস পেটাতে। আর টিটি সাহেবেরা তাঁদের কাছে টিকিট না চেয়ে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে জোরাজুরি করেছেন। মূলঘর স্টেশনে প্রায়ই বসতেন ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্থানীয় মানুষের ভাষায় ‘মবিল কোর্ট’, বেশির ভাগ টিকিট না কাটা লোকেরাই দুর্বল নিরাপত্তারক্ষীদের বেষ্টনী গলিয়ে বেরিয়ে যেতেন, আর ধরা পড়তেন খুলনায় তরকারি বেচে ট্যাঁকে ৪০ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে ফিরে আসা সখিনা-জরিনারা। এক ‘মবিল কোর্ট’-এই তাঁদের সারা দিনের কামাই সার!

খুলনা-বাগেরহাট রেলপথ ছিল দক্ষিণ বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। মাঝে কিছুদিন ছেদ পড়া সেই ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের আহ্বান যদি আসে, খুব অযৌক্তিক হবে না। তাই খুলনার সঙ্গে পুরোনো রেলপথ চালুর পাশাপাশি দ্রুতই ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত আসা রেলপথকে সম্প্রসারিত করতে হবে বাগেরহাট হয়ে মোংলা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত।

ট্রেনটিকে আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে বয়সী ঘোড়া! চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যেত, থেমে থেমে ঝিমাত। আবার ঠুক ঠুক করে পথ চলত। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাটাই দস্তুর। ওষুধপথ্য না দিয়ে মেরে ফেলা নয়। কিন্তু তাই করা হলো। ১৯৯৫ সালে এই রেলপথ বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হলো ১৯৯৮ সালে। ওই বছর রূপসা-বাগেরহাট শাখা লাইন বন্ধের নির্দেশ এল। অপসারণ করা হলো ২০০৬-০৭ সালে রেল ট্র্যাকসহ সব স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ। ২০১২ সালে সেসব সম্পদ নিলামে বিক্রি করে শাখা লাইনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। হাতুড়ি পড়ল লাখো রেলযাত্রীর স্মৃতির দেয়ালে।

৩.

বাগেরহাট-খুলনার মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে রেলপথ। একটা সময় ছিল খুলনা অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় না এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। কারণ, রাজশাহীর সঙ্গে চমৎকার রেল যোগাযোগ ছিল, যা এখনো আছে। ঢাকায় আসতে হতো বিপৎসংকুল নদীপথ পাড়ি দিয়ে। মাত্র ২৫ বছর আগে আমি নিজে ঢাকায় এসেছি পাঁচটি নদীপথ পাড়ি দিয়ে। আর ১৯৬৫ সালের আগপর্যন্ত দক্ষিণের মানুষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল কলকাতার সঙ্গে। বিয়েশাদির কেনাকাটার সঙ্গে মধ্যবিত্ত মানুষেরা কলকাতা শহরেই যেতেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে এমনই শুনেছি।

এত সব কথা বলার একটাই কারণ। দক্ষিণে রেল যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক এবং তাতে অবধারিতভাবে সংযুক্ত থাকুক হজরত খানজাহানের (রা.) পদস্পর্শে ধন্য বাগেরহাট জেলা। কথা হচ্ছিল তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বাগেরহাটের সদস্যসচিব ফররুক হাসান জুয়েলের সঙ্গে। তাঁর অনেক কথার ভিড়ে মূল কথা হলো, ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে সরাসরি ট্রেন লাইন বাগেরহাটে পৌঁছাতে হবে। আবার গোপালগঞ্জ পর্যন্ত যে লাইন আছে, তা-ও বাগেরহাট পর্যন্ত টেনে নেওয়া যেতে পারে।

মোংলা বন্দর, জলজ বন সুন্দরবন, স্বাদু পানির গলদা আর লোনা পানির বাগদা চিংড়ি, পাশাপাশি ষাটগম্বুজ মসজিদ, হজরত খানজাহানের (রা.) মাজারের জন্য বিশ্বব্যাপী বাগেরহাট জেলার নাম রয়েছে। যেকোনো উন্নয়নের অংশীদার হওয়া থেকে জেলাটি বঞ্চিত হবে না, এমন প্রত্যাশা করতেই থাকব।

উন্নয়নের পূর্বশর্তই হলো ভালো যোগাযোগব্যবস্থা। সড়কের পাশাপাশি রেল-নৌসহ সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন এই উন্নয়নের। তা না হলে বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে পিছিয়ে পড়বে একটি জনপদ। জিম্মি হবে সাধারণ মানুষ। রূপসা-বাগেরহাট রুটের ট্রেন বন্ধের পর যেই সংকট তীব্র হয়েছে এই অঞ্চলে। সহজ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যাতায়াতের রেলপথ বন্ধের পর সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়েছে গুটিকয়েক বাসমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে।

খুলনা-বাগেরহাট রেলপথ ছিল দক্ষিণ বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। মাঝে কিছুদিন ছেদ পড়া সেই ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের আহ্বান যদি আসে, খুব অযৌক্তিক হবে না। তাই খুলনার সঙ্গে পুরোনো রেলপথ চালুর পাশাপাশি দ্রুতই ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত আসা রেলপথকে সম্প্রসারিত করতে হবে বাগেরহাট হয়ে মোংলা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত। শুরুর কথাটা পুনর্বার বলি, সময় এসেছে আবার ইতিহাসের দাবিকে সামনে আনার, দায় পরিশোধের।

• কাজী আলিম-উজ-জামান, প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: alim.zaman@prothomalo.com