অভিমত

করতোয়া: কাগজ ধরে কি নদীর কখনো সীমানা হয়

দখল-দূষণে ছোট হয়েছে করতোয়া। পাউবোর রেগুলেটর স্থাপনসহ বেশ কিছু ভুল পরিকল্পনায় ভবিষ্যতে নদীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাও কঠিন হবে।

বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে বালাকৈগাড়ে মাটি ফেলে করতোয়া নদী দখল করা হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা।
ছবি: প্রথম আলো

দেশের উত্তরাঞ্চলের করতোয়া অনেক পুরোনো নদী। মহাভারতসহ বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থে এই নদীর উল্লেখ আছে। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, করতোয়ায় বাসনা পূরণ ও পাপমোচন হয়। এই নদীর নামকরণের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে শাস্ত্রীয় বিষয়। বলা হয়ে থাকে, শিবের হাত ধোয়া (কর ধোয়া) পানি থেকে এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে বলে নাম হয়েছে করতোয়া।

নদী-গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ও শেখ মেহ্‌দী মোহাম্মদ করতোয়া নদীর তীরবর্তী জনজীবন: অতীত ও বর্তমান শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, প্রাচীনকালে করতোয়া নদী ‘সদানীরা’ নামেও পরিচিত ছিল। সদা অর্থ সব সময় এবং নীর অর্থ পানি। সারা বছর প্রবহমান থাকত বলে করতোয়ার আরেক নাম ‘সদানীরা’।

মাহবুব সিদ্দিকী বলছিলেন, বগুড়ার শেরপুরে করতোয়া দুই ভাগ হয়ে গেছে। করতোয়ার পুরোনো প্রবাহ চলনবিলে আত্রাই নদে মিলেছে। নতুন প্রবাহটি ফুলজোড় নামে প্রবাহিত হয়েছে। আবার শেরপুর উপজেলার মির্জাপুরে কাশিয়াবালা এলাকায় করতোয়া দুই ভাগ হয়েছে। এর একটি শাখা ফুলজোড় নদ, অন্যটি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা উপজেলার ভূঁইয়াগাতিতে সূর্য বিল নদের সঙ্গে মিলেছে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর এলজিইডি আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ায় এই প্রবাহ অনেকটা মৃতপ্রায়।

করতোয়ার বর্তমান অবস্থার জন্য প্রথমত ও প্রধানত দায় পাউবোর (পানি উন্নয়ন বোর্ডের)। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে খুলসিতে ১০-১৫ ফুটের অপরিণামদর্শী রেগুলেটর স্থাপন করে পাউবো। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, অন্তত ৩০০ ফুট প্রস্থের নদীকে মাত্র ৮-১০ ফুটে সংকুচিত করা হয়েছে।

বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে করতোয়ার প্রবাহিত পানি কাটাখালী-বাঙালী নদী হয়ে চলে যেতে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যে পানির অভাবে করতোয়ার তলদেশ ভরাট হতে থাকে। বর্তমানে খুলসি এলাকায় উজানের করতোয়ার তলদেশের চেয়ে ভাটির করতোয়ার তলদেশ উঁচু। ফলে রেগুলেটরের ভাটির করতোয়া আর পানি পায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা এখানে যথাযথ—‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।’ করতোয়ার ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। পাউবো করতোয়ার এ অবস্থার জন্য দায়ী।

করতোয়ার কেন এমন অবস্থা

সম্প্রতি বেলার (বাংলাদেশ আইনবিদ সমিতি) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও এএলআরডির (অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদাসহ আমরা অনেকেই করতোয়া পরিদর্শন করেছি। শুরুতেই সেখানে দেখলাম পাউবোর রেগুলেটর। এরপর দেখলাম একটি বেসরকারি সংস্থা কীভাবে নদীকে দখল-দূষণ করছে।

বগুড়ার মহিষবাথান এলাকায় নদীর ভেতরে সীমানাখুঁটি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই খুঁটি সরকারিভাবে দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই বোঝা গেল না, কোন বিবেচনাবোধ, কী আইনে নদীর ভেতরে সীমানাখুঁটি দেওয়া হলো। খুঁটি লাগানোর সময় পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হকও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘প্রাথমিকভাবে সিএস নকশা অনুযায়ী সীমানাখুঁটি দেওয়া হয়েছে।’

নদীর চার ভাগের এক ভাগ অংশ দখলে নিয়ে সীমানাখুঁটি গাড়া হয়েছে। নদীকে প্রথম চোখ দিয়ে দেখতে হয়, তারপর কাগজ ধরে। সেটি না করে প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা কাগজ ধরে নদীর সীমানা দিয়েছেন। এতে বর্তমানের মূল প্রবাহই বাদ পড়েছে।

মহিষবাথানে নদীর পাশেই সড়কে একটি হাতনকশার বোর্ড। কেউ কেউ বলছেন, সড়কটিও করতোয়ার প্রবাহের ওপর করা। ‘করতোয়া নদীসংলগ্ন টিএমএসএস (ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ) এখতিয়ারাধীন জমির অবস্থান’ শীর্ষক হাতনকশায় লেখা আছে—‘জেলা বগুড়া, উপজেলা/থানা বগুড়া সদর, মৌজা বারবাকপুর, শাখারিয়া, বনমালীপাড়া, কইগাড়ি বড়, মহিষবাথান মৌজাগুলোর মধ্যে করতোয়া নদী ও টিএমএসএসসহ অন্যান্য মালিকানাধীন জমির সীমানা নির্ধারণ হাতনকশা।’

হাতনকশার নিচে জরিপ সমন্বয়ক ও হাতনকশাকার হিসেবে এলএলএস, টিএমএসএসের পরামর্শক (জরিপ) সার্ভে প্রশিক্ষক মো. আরিফ বিল্লাহর নাম লেখা আছে। এতে ১০ জন সার্ভেয়ারের স্বাক্ষর রয়েছে। এ রকম নকশা এবং তা-ও টাঙিয়ে রাখার ঘটনা জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।

করতোয়ার পারে জমি ইজারা

করতোয়া পরিদর্শনের দিন রাতে টিএমএসএসের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান মহিষবাথান এলাকায় নদী ভরাট করছিল। যে অংশটুকু ভরাট করা হচ্ছিল, তা ভেঙে নদীগর্ভে গেলেও ব্যক্তির মালিকানা বজায় আছে। সিএস নকশা অনুযায়ী সরকারিভাবে নদী থেকে তাঁদের জমি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।

হোসনে আরা জানালেন, তাঁরা ৯৯ বছরের জন্য করতোয়ার পারে ৪ একর ৯ শতক জমি ইজারা নিয়েছেন। ওই জমি সায়রতভুক্ত। সেই স্থানে গড়ে উঠেছে টিএমএসএসের ছাত্রাবাসসহ নানা কার্যক্রম।

সরকার কীভাবে এই জমি ইজারা দিয়েছে, সেটি বোধগম্য নয়। হোসনে আরার দেওয়া তথ্য সঠিক হলে, যেসব কর্মকর্তা নদীর সীমানাখুঁটি নদীর ভেতরে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, সরকারি জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছেন, তাঁদের দায়ও কম নয়।

কয়েক দিন পর গণমাধ্যমের খবরে জেনেছি, টিএমএসএস কর্তৃপক্ষ আবার নদী ভরাট করছিল। সেখানে জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে কয়েকটি ট্রাক থানায় নিয়ে যায়। পাউবোর পক্ষ থেকে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে মে মাসের গোড়ার দিকে মামলাও করা হয়েছে।

বগুড়া শহরের কয়েকটি স্থানে করতোয়া পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেল, করতোয়ার অবস্থা গত বছরের চেয়েও খারাপ। বগুড়া পৌরসভা, এমনকি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ময়লা-আবর্জনাও করতোয়ায় ফেলা হয়। শহরের ময়লা-দূষিত পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে নদীর সঙ্গে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সঙ্গে নদীর ভেতরেই ভরাট করে এক ব্যক্তি সীমানাপ্রাচীর তুলেছেন।

দেওনাই নদে বেঁচে আছে করতোয়া

বর্তমানে করতোয়া নদীর পানির প্রধান উৎস দেওনাই নদ। নদটি নীলফামারীর ডোমার উপজেলা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। করতোয়াকে বাঁচাতে হলে মূলত দেওনাই নদের উপনদী এবং উপনদীর শাখা উপনদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। নইলে করতোয়াকে বাঁচানো যাবে না।

করতোয়াকে বাঁচাতে খুলসিতে পাউবোর তৈরি রেগুলেটর তুলে ফেলতে হবে। পানির প্রবাহ ফেরাতে সেখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করতে হবে। নদীর দখল উচ্ছেদ করতে হবে। দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে। উচ্চ আদালত এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনা পালন করতে হবে। নদী রক্ষা নিশ্চিত করতে বগুড়ার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে।

  • তুহিন ওয়াদুদ অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। ইমেইল:

    wadudtuhin@gmail.com