মতামত

প্রাণদায়ী খাবার স্যালাইন যখন ‘প্রাণঘাতী’

বেশির ভাগ মানুষই খাবার স্যালাইন তৈরির প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করতে ভুল করেন। তাঁদের ধারণা, বেশি যখন পায়খানা হচ্ছে, তখন একটু ঘন করে গোলানো স্যালাইন পানি বারবার শিশুকে খাওয়ালে মনে হয় তাঁর সন্তান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
ফাইল ছবি

সন্তান তাঁর আইসিইউতে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি খুবই বিপর্যস্ত। এখানে তাঁর নাম–পরিচিতি বা পেশা কোনোটাই জরুরি নয়। তারপরেও ধরুন মায়ের নাম রিমা। ইংরেজিতে অনার্স, এমএ। ঢাকার এক পরিচিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। দুটি সন্তান তাঁর; মেয়েটি বড়, ছেলেটি ছোট। ছেলেটির নাম প্রিন্স। সে হাসপাতালে ভর্তি।

রিমা জানতেন, ডায়রিয়া হলে খাওয়ার স্যালাইন দিতে হয়। তিনি সেভাবেই শুরু করেছিলেন।কিন্তু শিশু প্রিন্স শকে চলে যায়। এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। ডায়রিয়া হয়েছে, শুরু থেকেই ‘ভালো কোম্পানি’র প্যাকেট থেকে স্যালাইন বানিয়ে বানিয়ে বারবার খাওয়ানো হয়েছে, তারপরেও প্রিন্স কেন জীবন–মৃত্যুর মাঝামাঝি খাবি খাচ্ছে!

ব্যস্ত চিকিৎসককে প্রায়ই এ রকম বোকা বোকা প্রশ্ন শুনতে হয়, তারপরেও তিনি এই বোকাকে বকা না দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করলেন।

জানালেন, বেশির ভাগ মানুষই খাবার স্যালাইন তৈরির প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করতে ভুল করেন। তাঁদের ধারণা, বেশি যখন পায়খানা হচ্ছে, তখন একটু ঘন করে গোলানো স্যালাইন পানি বারবার শিশুকে খাওয়ালে মনে হয় তাঁর সন্তান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।

প্রিন্সকে হাসপাতালে আনার আগে গত তিন দিনে মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, মাত্র ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১টি স্যালাইন গ‍ুলিয়ে শিশুটিকে খাওয়ানো হয়েছে। ৩ দিনে এভাবে মোট ১২ প্যাকেট স্যালাইন খাওয়ানো হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। মৃত্যুর সঙ্গে এখন লড়া প্রিন্সকে দিনে কয় প্যাকেট খাওয়ানো হয়েছে, তার সঠিক হিসাব মা জানাতে পারেননি।

দেড় বছরের শিশুর পক্ষে কম সময়ের মধ্যে লবণের এত চাপ সহ্য করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবার পায়খানা করার পর দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে মাত্র ১০ থেকে ২০ চা–চামচ স্যালাইন পানি দেওয়ার নিয়ম। বেশির ভাগ মা এই  হিসাবটার আমলে নেন না বা জানেন না।

চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ১৯৭৮ সালের ৫ আগস্টের সম্পাদকীয়তে বলেছিল, ওআরএসের আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এই আবিষ্কার তীব্র ডায়রিয়া চিকিৎসায় মুখে তরল খাওয়ানোর রাস্তা খুলে দিয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে জীবন রক্ষাকারী নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি বা ওষুধ সাধারণত জটিল ও ব্যয়বহুল হয়। অনেকের কাছে দুষ্প্রাপ্য। ওআরএস এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

হাসপাতালে হাসপাতালে এখন ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্ষার আগে, বর্ষার পরে আর শীতের সময় ডায়রিয়ার পারদ ওপরের দিকে উঠতে থাকে। স্যালাইনের বেচাকেনা বাড়ে। রোগী সামাল দিতে হিমশিম খায় কলেরা হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা হাসপাতাল।

রোগীর স্রোত সামাল দিতে শামিয়ানা টানাতে হয়। কয়দিন আগেও আইসিডিডিআরবি মহাখালীতে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ ডায়রিয়া রোগী আসছিল, সেখানে ১৬ জুন একপর্যায়ে রোগীর সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে যায়। এটা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ।

পাহাড় থেকে মৃত্যুর খবর এসেছে। বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গম লংথিয়ানপাড়া এলাকায়  সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। রোগীর এই চাপ আরও জটিল করে তুলতে পারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ভুল মাত্রা আর পদ্ধতিতে স্যালাইন খাওয়ালে।

এ বছরে এখন পর্যন্ত মোট কতজন ভুল স্যালাইন থেরাপির শিকার হয়ে হাসপাতালে আসছে, সে হিসাব এখনো তৈরি হয়নি। তবে এই সংখ্যা যে ক্রমে বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকা শিশু হাসপাতাল ২০১৮ সালে এ রকম রোগীর একটা হিসাব তৈরি করেছিল।

সে বছর ভুলের শিকার হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় চল্লিশের বেশি শিশু, যাদের বেশির ভাগই মারা যায়। সঠিক নিয়মে ওরস্যালাইন তৈরি ও না খাওয়ানোর কারণে এটা হয় বলে সেই সময় জানিয়েছিলেন হাসপাতালটির একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

ভুল মাত্রায় স্যালাইন খাওয়ালে আসলে কী হয়

গুঁড়া আকারে প্যাকেটে  যে ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট পাওয়া যায়, তার মধ্যে থাকে লবণ অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, গ্লুকোজ এবং ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট।

নিয়ম হচ্ছে, প্যাকেটের সবটুকু গুঁড়া আধা লিটার (ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নেওয়া) পানিতে  ভালো করে গুলিয়ে খাওয়ানো।

এখন কেউ যদি এর চেয়ে অল্প পানিতে স্যালাইন মিশিয়ে খাওয়ান, তাহলে স্বাভাবিকভাবে শরীরে লবণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। এর প্রভাবে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের। একসময়  কোষগুলো নষ্ট হবে এবং তা থেকে মৃত্যু হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

সোডিয়াম ক্লোরাইড রক্তে থাকার কথা ১৩৫-১৪৫ মিলিমোল/লিটার, এই মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই শিশুর অবস্থা টালমাটাল হতে বাধ্য। ঢাকার একটি ক্লিনিকে একটি শিশুর রক্তে ১৬৫ মিলিমোল সোডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়ার পর শিশুটিকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

শিশুটির মা নাকি বাড়িতে একটু একটু করে ওআরএস নিয়ে একটু পানিতে মিশিয়ে শিশুকে বারবার খাইয়েছিলেন। ফলে লবণ পানির যে অনুপাতটা রক্ষা করা উচিত ছিল, সেটা রক্ষা করা হয়নি; আর তাতেই বিপর্যয় নেমে আসে।

অনেকেরই বিশ্বাস, শিশু ছোট বলে অল্প অল্প করে স্যালাইন বানাতে হবে অর্থাৎ স্যালাইনের প্যাকেট পুরোটা না মিশিয়ে সামান্য গুঁড়া নিয়ে অল্প পানি দিয়ে বানানো যাবে। আসলে স্যালাইনের প্যাকেটে যে উপাদান আছে, তা কাজ করতে হলে পুরো আধা লিটার পানি দিয়েই দ্রবণ তৈরি করতে হবে। পানি কিংবা স্যালাইন কোনোটাই কম-বেশি করে মেশানো যাবে না; অল্প পানিতে বেশি স্যালাইনের গুঁড়া দিলে কাজ তো হবেই না; বরং কিডনির সমস্যা হতে পারে।

এ রকম জটিল অবস্থা থেকে ভাগ্যক্রমে শিশু বেচে গেলেও আবার অনেকে বিকলাঙ্গ, আবার কারও মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে (ব্রেন ড্যামেজ) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই ওরস্যালাইন ব্যবহারের সঠিক বার্তাটি জনগণের কাছে বারবার পৌঁছানো দরকার।

প্যাকেটের গায়ে লেখা বার্তা পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন

ওআরএস সাশ্রয়ী করতে গিয়ে প্যাকেট দিন দিন ছোট করায়, লেখাগুলো সহজে পড়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া কম লেখাপড়া জানা মায়েদের কথা চিন্তা করে এক পোয়া, দুই পোয়া যে কথা লেখা আছে, সেটা এখন আর শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়; বরং গ্রামেও অবোধ্যগম্য। গ্রামের শিশুটিও জানে আধা লিটার আর আধা সের এক জিনিস নয়।  

মানুষকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে হবে

আধা লিটার পানিতে এক প্যাকেটের পুরো ওরস্যালাইন মেশাতে হবে, এর চেয়ে বেশি বা কম না।
কখনোই গরম পানিতে স্যালাইন বানাবেন না।

পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে তারপর স্যালাইন মেশাতে হবে। তা না হলে জীবন রক্ষাকারী স্যালাইন হয়ে যেতে পারে মৃত্যুর কারণ।

বানানো স্যালাইন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে, এরপরে খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। ১২ ঘণ্টা পরে স্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন হলে একই পদ্ধতিতে নতুনভাবে বানিয়ে নিতে হবে।

সামান্য ভুলের খপ্পরে শতাব্দীর অন্যতম সেরা উদ্ভাবন

চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ১৯৭৮ সালের ৫ আগস্টের সম্পাদকীয়তে বলেছিল, ওআরএসের আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এই আবিষ্কার তীব্র ডায়রিয়া চিকিৎসায় মুখে তরল খাওয়ানোর রাস্তা খুলে দিয়েছে।

গবেষণার মাধ্যমে জীবন রক্ষাকারী নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি বা ওষুধ সাধারণত জটিল ও ব্যয়বহুল হয়। অনেকের কাছে দুষ্প্রাপ্য। ওআরএস এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

মানুষের কাছে  উদ্ভাবনের বার্তা পৌঁছানো সহজ ছিল না

‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি’ ফর্মুলা নিয়ে মাঠে নামে ব্র্যাক। ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা প্রতিটি বাড়ির অন্তত একজন সদস্যকে দ্রবণ তৈরি করতে শেখান। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন নিয়মিত প্রচার চালায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্র্যাকের এই কর্মসূচি ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। সাধারণ মানুষ স্যালাইন তৈরি করতে শিখেছেন।

এখন সময় এসেছে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নতুন প্রজন্মকে তাদের পছন্দের মাধ্যম ব্যবহার করে বিষয়টি আবার ঝালাই করানো। ব্র্যাকের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়েছিলেন, এখন কানে কানে পৌঁছাতে হবে।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ইমেইল: nayeem5508@gmail.com