পড়ন্ত ফাল্গুনের শেষ দুপুর। রোদটাও তাতিয়ে উঠেছে। চৈত্র মাসের আভাস সেই রোদে। যদিও এই ঢাকা শহরে বাংলা ক্যালেন্ডারের হাওয়া বোঝা বড়ই মুশকিল।
যা–ই হোক, গত শনিবার (৯ মার্চ) বেলা সাড়ে তিনটা বাজতে না বাজতেই হাজির হয়েছি অফিসের নিকট দূরত্বে ফার্মগেট সংলগ্ন গ্রিন রোডে—ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) কার্যালয়ে। সেখানে বই নিয়ে একটি আড্ডায়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএলের কার্যালয়ে বই নিয়ে আড্ডার অনুষ্ঠানে আগেও আসা হয়েছে। তবে আজকে যে দুটি বই নিয়ে আড্ডা, তার আলাদা দুটি তাৎপর্য আছে।
এক. বই দুটির লেখক অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁকে আলাদা করে পরিচয় করে দেওয়ার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। তবে তাঁর বই নিয়ে আড্ডা, তিনি নিজেই যেহেতু সেখানে আলোচক, তাই রেহমান সোবহানের কাছেই আমাদের বাঁধা পড়তে হয়। দুই. রেহমান সোবহানের এ দুটি বই হচ্ছে আত্মজীবনী। তিন খণ্ডে আত্মজীবনী লিখছেন তিনি। ফলে বলা যায়, বই দুটি হলো তাঁর আত্মজীবনীর দুই খণ্ড।
আত্মজীবনীর নাম—আনট্রাঙ্কুয়েল রিকালেকশনস। এই শিরোনামের পর খণ্ড দুইটির নামকরণ হয়েছে এভাবে—দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলম্যান্ট এবং ফ্রম ডন টু ডার্কনেস। খণ্ড দুটির মাধ্যমে রেহমান সোবহান তাঁর জীবনকে দুটি পর্বে মলাটবদ্ধ করেছেন।
প্রথম খণ্ডের ব্যাপ্তিকাল রেহমান সোবহানের জন্ম থেকে ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, যেদিন তিনি মূলত স্বাধীন দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকাতে প্রথম পা রাখেন। আর পরের খণ্ডটি শুরু হয়েছে ১৯৭২ সালের প্রথম দিন থেকে এবং ১৯৭৫ সালের শেষ পর্যন্ত। খণ্ড দুটি নিয়ে আলোচনায় হাজির হন রেহমান সোবহান নিজে।
একটু জানিয়ে রাখি। এ আত্মজীবনীর খণ্ড দুটি আমরা আগেই একবার প্রকাশ হতে দেখি ভারতীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেজ পাবলিকেশনস থেকে। সেজেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ভাষা প্রকাশনী থেকে প্রথম বইয়ের বাংলা অনুবাদও বের হয়, উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো এই নামে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন জানান, সেজ থেকে বই দুটি তাঁরা নিয়ে এসেছেন এবং নতুন করে প্রকাশ করেছেন। সেগুলো এখন ইউপিএলের প্রকাশনা।
তিনি আরও জানান, অচিরেই এ দুই খণ্ডের বাংলা অনুবাদও পাঠকদের জন্য নিয়ে আসছে ইউপিএল। এই আত্মজীবনী শুধু রেহমান সোবহানের জীবনের সাক্ষ্যই নয়, আমাদের দেশের ইতিহাসের সাক্ষ্যও। এ আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড হয়ে গেলে রেহমান সোবহানের একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী আমরা পেয়ে যাব।
আড্ডাটির সঞ্চালনায় ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ আখতার মাহমুদ। আড্ডার শুরুতে রেহমান সোবহানও জানালেন, ভারত থেকে প্রকাশিত হওয়ার কারণে তাঁর আত্মজীবনীর এ খণ্ডগুলো সংগ্রহ করা পাঠকদের জন্য সহজলভ্য ছিল না। ইউপিএলের উদ্যোগের কারণে এখন সেটি সম্ভব হয়েছে।
এরপর ধীরে ধীরে সঞ্চালক আমাদের টেনে নিয়ে যান আড্ডার মূল পর্বে। মূলত প্রশ্ন-উত্তর দিয়েই সাজানো ছিল আড্ডাটি। দুই পর্ব নিয়ে সাজানো দুই সেশনে প্রশ্নকর্তা হিসেবে যুক্ত ছিলেন দর্শক-শ্রোতারাও । সেখানে ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ নানা পরিচয়ের মানুষ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান ও মানবাধিকার নেত্রী হামিদা হোসেনের কথা আলাদাভাবেই বলতে হয়।
হামিদা হোসেনের জন্ম রেহমান সোবহানের কাছাকাছি সময়েই। দুজনই বন্ধু। বাংলাদেশের সৃষ্টির আগে একসঙ্গে পত্রিকা বের করেছিলেন তাঁরা। সেই পত্রিকায় উঠে এসেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুঃখ–দুর্দশা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং একই সঙ্গে আশা–আকাঙ্ক্ষার কথাও। দর্শকসারি থেকে হামিদা হোসেন সম্ভবত এমনটিই বললেন, এই আত্মজীবনী না পড়েও এর অনেক কিছুই তিনি বলে দিতে পারবেন। যেহেতু বন্ধু রেহমান সোবহানের বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল পথচলার একজন নিবিড় প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।
প্রথম পর্ব নিয়ে আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে ১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া রেহমান সোবহানের শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের দিনগুলো। তিনি বলছেন, তাঁর মা ছিলেন প্রচণ্ড সিনেমাপ্রেমী। মাত্র তিন বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে তিনি সিনেমা দেখতে যান হলে। ঢাকার নবাব পরিবারের ছিল তাঁর নানাবাড়ি। পাকিস্তানের একসময়ের গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছিলেন তাঁর নানা।
উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বাবার চাকরির সুবাদে রেহমান সোবহানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। পড়াশোনার জন্য কেটেছে দার্জিলিং, লাহোর, কেমব্রিজে। দার্জিলিংয়ের স্কুলে পড়ার সময় তিনি খেলাপাগল ছাত্র বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ, তিনি ছিলেন স্কুলের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। হকি দলের ভাইস ক্যাপ্টেন। ছিলেন ম্যারাথন চ্যাম্পিয়নও। খেলতেন টেনিসও।
কেমব্রিজে পড়াকালে রেহমান সোবহান সিদ্ধান্ত নেন তিনি ঢাকাতেই থিতু হবেন। তিনি বলেন, এটি ছিল তাঁর একই সঙ্গে পলিটিক্যাল ও আইডিওলজিক্যাল সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিস্থিতির মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন।
যে পরিবারে রেহমান সোবহান জন্মেছিলেন, সেটিই শুধু তাঁর পরিবার ছিল না। তাঁর রেহমান সোবহান হয়ে ওঠার পেছনে মায়ের পরিবার ও শ্বশুরবাড়িও এখানে তাঁর পরিবার হয়ে ওঠে। এই বৃহৎ পরিবারের কারণে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতি ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেখেছেন। যা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। লন্ডনে পড়াশোনার সময় তাঁর ভেতরে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধও তাঁকে তাড়িত করে ঢাকায় আসতে।
লন্ডন থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসার পর তাঁর বাবা ঢাকায় তাঁদের পারিবারিক চামড়ার ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিতে চাইলেন। রেহমান সোবহানের ভাষায়, এটি ছিল তাঁর বাবার পিকিউলিয়ার আইডিয়া বা অদ্ভুত চিন্তা। চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত হওয়া নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে দ্বৈরথের বিষয়টিও উঠে আসে বক্তব্যে।
এরপর তো তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত হয়ে গেলেন। সে সময় প্রত্যক্ষ করেন পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সেই সময়ের ছাত্র-জনতার রাজনীতি।
এর আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার খসড়া তৈরি ও নির্বাচনের ইশতেহার তৈরিতে যুক্ত থাকা এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীনের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক মিশনে যোগ দেওয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন রেহমান সোবহান।
বর্তমানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নাম বললেই মোটাদাগে তাঁর একটি পরিচয় উঠে আসে—অর্থনীতিবিদ। কিন্তু এটি বেশ জোরালোভাবেই বলা যায় যে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অন্যতম এক ভাষ্যকারও।
আলোচনা থেকেই একটি বিষয় পরিষ্কার, তাঁর আত্মজীবনী মোটেই ঘটনাপ্রবাহ নয়। সেখানে নিজের মতাদর্শ, চিন্তা ও পর্যবেক্ষণী শক্তি দিয়ে প্রতিটি ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। তাঁর প্রতি একটি প্রশ্ন ছিল এমন—আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে একটি সমালোচনা সব সময়ই থাকে যে, সেখানে লেখক স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই অনেক কিছুই বাদ দেন বা উল্লেখ করেন না। এখানেও তেমনটি ঘটেছে কি না?
বর্তমান ও আগামী ১০ বছরের বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন হলো, আগের তুলনায় সমাজে অসমতার মাত্রা অনেক বেড়েছে। সমাজে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রগতি হয়েছে। যেমন গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, অর্থনৈতিক উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। তবে সমাজে যাদের হাতে বেশি সম্পদ রয়েছে, রাজনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক শক্তি এখানে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এটিই হলো আজকের সমাজের বাস্তবতা, যা বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সঙ্গে মোটেও সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
রেহমান সোবহান বলেন, ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে বিশদভাবে আনার চেয়েও মানুষের আগ্রহ আছে এমন বিষয়গুলোকে তিনি আত্মজীবনীতে প্রাধান্য দিয়েছেন।
আমরা কথায় কথায় জানতে পারি, রেহমান সোবহানের আজকের রেহমান সোবহান হয়ে ওঠার পেছনে তিনজন নারীর কথা। একজন ছিলেন তাঁর মা। মা হাসমত আরা বেগম তাঁর মানসগঠনে বড় ভূমিকা রাখেন, তাঁর দেখার চোখ তৈরি করেন।
আরেকজন নারী তাঁর প্রথম স্ত্রী, প্রয়াত সালমা সোবহান। দেশের নারীর অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়নের অসামান্য ভূমিকা ছিল তাঁর। যিনি ৪৩ বছর ধরে রেহমান সোবহানের সময়ের একনিষ্ঠ সাক্ষী ও সঙ্গী ছিলেন। দ্বিতীয় খণ্ডটি সালমা সোবহানকে উৎসর্গ করেছেন তিনি। আর তৃতীয় নারী ছিলেন আড্ডার দর্শকসারির সামনেই, তাঁর বর্তমান স্ত্রী দেশের খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান।
এরপর দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় উঠে আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, নতুন একটি দেশের নীতিনির্ধারণে নানা প্রতিবন্ধকতা, আমলাতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রের মধ্যে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনসহ সে সময়ের সরকারের ভেতর-বাইরের নানা বিশ্লেষণ।
মুক্তিযুদ্ধের পর অবাঙালি ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা এখান থেকে চলে যাওয়ায় শিল্প-বাণিজ্যে যে শূন্যতা তৈরি হয় এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প ও কলকারখানা সরকারীকরণ করা হয়, সেই সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ছিল তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুই-ই ছিল।
রেহমান সোবহান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কমিশনে কাজ করতে গিয়ে অনেক কাছ থেকেই দেখেন যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ ও এর অর্থনৈতিক যাত্রা। সে সময়ের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নানা বাস্তবতার পাশাপাশি উন্নয়নের পথের প্রতিবন্ধকতাগুলোও তিনি পর্যবেক্ষণ করেন নিবিড়ভাবে। তবে সরকারদলীয় স্বার্থরক্ষা, আমলাতন্ত্রসহ নানা অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে তাঁদের পরিকল্পনা কমিশন ঠিকঠাক কাজ করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে ও সদ্য স্বাধীন দেশ গঠনের প্রসঙ্গে বারবার বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের নাম উচ্চারণ করছিলেন তিনি। দুজনের সঙ্গে একেবারে কাছ থেকে কাজ করার বিষয়ই গুরুত্ব পেয়েছে সেখানে।
সে সময় অবশ্যম্ভাবী একটি প্রশ্ন চলেই আসে। দুজনকেই যেহেতু একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন, একসঙ্গে কাজ করেছেন ফলে দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ার বিষয়টি তিনিই ভালো জানার কথা। তখন রেহমান সোবহান বলেন, ‘বিষয়গুলো এ আলোচনায় খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। অনেকে এ নিয়ে লিখেছেন। তাজউদ্দীনের মেয়েও বইপত্র বের করেছেন।’
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে রেহমান সোবহানের মূল্যায়ন বেশ স্পষ্ট। তিনি বলছেন, রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে জনগণের নেতা। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা স্পন্দন সহজে বুঝতে পারতেন তিনি। তিনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেন, তবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে ভুলতেন না। ত্রিকালদর্শী রেহমান সোবহান দুঃখ করে বললেন, দেশের নীতিনির্ধারকদের এখন খুব কমই জনস্বার্থের বিষয়গুলোর গভীরে যেতে দেখেন তিনি।
এরপর আলোচনা গড়ায় পঁচাত্তরের দিকে। শ্রোতাদের একজনের কাছ থেকে একটি প্রশ্ন আসে এমন—বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আপনার কী মনে হয়েছিল? তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কী ভাবলেন এবং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ এখন যে জায়গা দাঁড়িয়ে, তাতে আপনার পর্যবেক্ষণ কী এবং আগামী ১০ বছরে দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে দেখছেন?
রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অক্সফোর্ডে চলে যান। পরে ঠিকই দেশে ফিরে আসেন। তবে দেশকে অনেকটা আইয়ুব খানের পাকিস্তানের মতো মনে হতে থাকে তাঁর। বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত সফলভাবে জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের চাকাকে উল্টো পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকে জনমানসে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বর্তমান ও আগামী ১০ বছরের বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন হলো, আগের তুলনায় সমাজে অসমতার মাত্রা অনেক বেড়েছে। সমাজে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রগতি হয়েছে। যেমন গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, অর্থনৈতিক উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। তবে সমাজে যাদের হাতে বেশি সম্পদ রয়েছে, রাজনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক শক্তি এখানে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এটিই হলো আজকের সমাজের বাস্তবতা, যা বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সঙ্গে মোটেও সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
সরকার পরিচালনা প্রসঙ্গে রেহমান সোবহান যা বললেন, তা আজকের বাস্তবতায় চরম সত্য। তিনি বললেন, সমালোচনাকেই সরকারের উচিত তার সেরা উপদেষ্টা হিসেবে দেখা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যেকোনো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করতে গেলে চাহিদা ও সরবরাহ উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি দেখা যায়। নীতিনির্ধারকেরা সরকারের ভেতর থেকে যে পরামর্শ পান, তা প্রায়ই ভুলগুলোকে শক্তিশালী করতে পারে এবং বিভ্রান্তিকর হতে পারে। আর গঠনমূলক ও গভীর সমালোচনা থেকে অনেক কিছু শেখা যায় এবং তা নীতি তৈরি ও উন্নতিতে সহায়তা করে। সমালোচকদের সমালোচনা করা বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে একমত না হওয়া একটি সমস্যা, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয়গুলোর একটি।
সঞ্চালক আড্ডা শুরু করার আগেই রেহমান সোবহানকে জন্মদিনের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানালেন। কারণ ১২ মার্চ ছিল তাঁর ৮৯তম জন্মদিন। এ লেখাটি যখন লিখছি, তিনি তখন নব্বই বছরে পা রাখলেন। কিন্তু সেদিনের দুই ঘণ্টার বেশি সময়ের দীর্ঘ আলোচনায় অধ্যাপক সোবহানকে মনে হলো প্রাণোচ্ছ্বল এক তরুণ। আর তারুণ্য মানেই তো স্বপ্ন, সম্ভাবনা। যে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে একদিন বিলেত মুল্লুক থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন, পূর্ববঙ্গকেই নিজের দেশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আলো যেন আজও ঠিকরে পড়ছে তাঁর চোখ দিয়ে।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com