বলতে বাধ্য হচ্ছি, সম্প্রতি গ্যাজেটকৃত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপে নেই কোনো পরিকল্পনা। সংশ্লিষ্টরা হয়তো ভেবেছিল কোনো পরিকল্পনা না থাকাটাই সেরা পরিকল্পনা!
আমার নিজের জন্য করুণা হয় যে, দেশে–বিদেশে পরিকল্পনা তৈরির প্রায় ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েও আমি ড্যাপে এমন একটি পরিকল্পনা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি, যা নিয়ে অনেক লোক আগ্রহী। মনে হয় পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার এখনো আরও কিছু শেখা বাকি!
আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বলে যে, পরিকল্পনা হলো একটি অপরিকল্পিত এলাকার প্রতি ইঞ্চি জমি নিয়ে কী করা উচিত তার আগাম প্রস্তুতি, যাতে এটি ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতে পারে। দেশের আইন অনুযায়ী একটি ‘যোগ্য সংস্থা’ তাদের এখতিয়ারাধীন এলাকার জন্য [ভূমি-ব্যবহার] মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করবে। ঢাকার জন্য সেই আইনানুগ উপযুক্ত সংস্থাটি ছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পূর্বে যা ছিল ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)। ১৯৯৭ সালে, রাজউক একটি তিন স্তরের মহাপরিকল্পনা তৈরি করে, যাতে ছিল স্ট্রাকচার প্ল্যান (ডিএসপি) বা কাঠামোগত পরিকল্পনা, আর একটি করে ১৯টি অঞ্চলের জন্য তৈরি ইউএপি বা নগর এলাকা পরিকল্পনা। এগুলোর অধীনে বাস্তবায়নের জন্য ড্যাপ ছেড়ে দেওয়া হয় স্থানীয় পরামর্শদাতাদের হাতে।
একটি স্ট্রাকচার প্ল্যানে আমরা কী করি? পূর্ববর্তী পরিকল্পনার মূল্যায়ন করি, বর্তমান পরিস্থিতি এবং প্রবণতা সম্পর্কে অধুনা সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করি, একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা রূপকল্প নির্ধারণ করি এবং তা প্রয়োগের নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিই। নগর এলাকা পরিকল্পনার স্তরে আমরা নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে কৌশলগুলো গ্রহণ করব তা ঠিক করি এবং একেবারে মাঠপর্যায়ে ড্যাপে আমরা ভূমি-ব্যবহার এবং পরিবহন ব্যবস্থাকে নির্দিষ্ট করে দিই। অবশ্যই, পরিকল্পনার সবকিছুই ভৌত বিষয় নয়; এখন এটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কীভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যায়, কীভাবে প্রতিকূল জলবায়ুর প্রভাব প্রশমিত করা যায়, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা যায় ইত্যাদি।
আবারও বলছি, ড্যাপের উচিত স্ট্রাকচার প্ল্যানের সিদ্ধান্তগুলো অনুসরণ করা এবং ইউএপিতে সিদ্ধান্তকৃত কৌশলগুলো ব্যবহার করা। ব্যাপারটি একটি বা দুটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। ধরুন স্ট্রাকচার প্ল্যানে বলা হলো কোনো আন্তজেলা পরিবহন শহরের মধ্য দিয়ে চলাচল করবে না। তাই বিকল্প রাস্তা বোঝানোর জন্য ইউএপি শহরের মানচিত্রে প্রান্ত বরাবর একটি মোটা বাঁকানো রেখা আঁকতে পারে। আর ড্যাপ দেখাবে একেবারে সঠিক মাপে কার বা কোন জমির ওপর দিয়ে কোনমুখী এ সড়ক যাবে। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। স্ট্রাকচার প্ল্যান ১৯৯৫ কোনো নতুন প্রান্তিক এলাকা উন্নয়নে ১২ শতাংশ এলাকা জল ধরে রাখার জন্য জলাধার রাখতে বলেছে। ইউএপি এগুলো ঢাকার বহিরাঞ্চলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বড় বৃত্ত দিয়ে দেখিয়েছে। ড্যাপের উচিত ছিল জলাধারগুলোর সঠিক অবস্থান এবং সমস্ত এলাকার মধ্যে প্রতিটি নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা তার এলাকায় কোথায় জল ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখবে তা দেখানো এবং এ নির্দিষ্ট জলাধারগুলো কখনোই ভরাট করা যাবে না। বর্তমান ড্যাপের কোথাও এ ধরনের বিস্তারিত প্রকৃত পরিকল্পনা অনুপস্থিত। যা হতে পারতো একটি আসল পরিকল্পনা। একটি অপরিকল্পিত এলাকায় বর্তমান বিশৃঙ্খল ও গোঁজামিল ব্যবহারের বিপরীতে কী হওয়া উচিত, তা নির্দিষ্ট করে দিতে পারতো এ পরিকল্পনা। যার কিছুই হতে দেখি না আমরা।
ড্যাপ একটি ভবিষ্যৎ রূপকল্প দিচ্ছে। তবে এ রূপকল্প কার এবং তা কীভাবে বিনির্মিত, তা স্পষ্ট নয়। এটা কি ড্যাপ প্রণয়নকারী দল বা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকল্প পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি, রাজউকের দৃষ্টিভঙ্গি নাকি কোনো আইনপ্রণেতা বা মেয়রের দৃষ্টিভঙ্গি? এটা অবশ্যই আমার দৃষ্টিভঙ্গি নয় এবং সর্বজনীন নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গিও নয়। কারণ যদি তা হয়, তবে আমরা অবশ্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণে রূপকল্প প্রণয়নে অংশগ্রহণ করিনি। একটি শহরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করতে হবে সব অংশীজনের পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে, যার মধ্যে সবার ওপরে হচ্ছে এ শহরের নাগরিকেরা।
ঢাকার মাপের একটি শহরে কি তার পুরো এলাকার জন্য বিশদ পরিকল্পনা থাকতে পারে? উত্তর হলো, না। এটির পরিবর্তে আগে শুধু অপরিকল্পিত এলাকাগুলোর বিশদ পরিকল্পনা প্রস্তুত করা উচিত। এর মাঝে আছে বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক বসতি, নতুন ভরাটকৃত এলাকা, বর্ধিষ্ণু শহুরে ব্যবহারের এলাকা, প্রান্তিক এলাকা, এবং নতুন নিকটবর্তী উপশহরগুলো। সাম্প্রতিক ড্যাপে স্ট্রাকচার প্ল্যান অধিকৃত এলাকাকে ১৮টি কেন্দ্রীয় উপ-এলাকায় এবং ৮টি সম্প্রসারিত উপ-এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। এ সমস্ত ক্রমবর্ধমান এলাকায় সমস্ত ভবিষ্যৎ সিদ্ধ ভূমি ব্যবহার এবং প্রসারিত রাস্তার ‘রাইট অফ ওয়ে’ দেখানো থাকা উচিত। কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোর মধ্যে (সম্ভবত ইতিমধ্যেই পরিকল্পিত এবং/অথবা পরিপূর্ণ নির্মিত) যদি বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে থাকে (লঙ্ঘন বা বিবর্তন বা অন্যান্য কারণে), সেগুলো ড্যাপে যাচাই করে বা নতুন ব্যবহার নির্ধারণ করে এবং সংশোধনমূলক নির্দেশনা দিয়ে দেখাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বিরাজমান অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপটের কারণে ৬৫ বছরের পুরোনো তেজগাঁও শিল্প এলাকাটি একটি মিশ্র প্রাতিষ্ঠানিক-বাণিজ্যিক অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে, যা আরও পরিবর্তিত হতে চলেছে। এখানে ড্যাপ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করবে ও এই এলাকায় ভবিষ্যৎ ব্যবহারের নির্দেশনা দেবে। ড্যাপ এ এলাকার জন্য কার্যত কিছুই করেনি! এটি নির্বিচারে বর্তমান ব্যবহারগুলোকে বৈধ করেছে এবং শিল্প এলাকা এবং হাতিরঝিলবেষ্টিত এলাকায় সমস্ত অপরিকল্পিত অনানুষ্ঠানিক ব্যবহারগুলো তাদের দখলকারীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে! এলাকাটির বেশিরভাগ জমিই প্রকৃতপক্ষে গত কয়েক দশকে ঝিল ভরাট করে উদ্ধার করা হয়েছে অথবা অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। সরু আঁকাবাঁকা গলিতে ঠাসা বেশির ভাগই অস্থায়ী ঘরবাড়িতে পূর্ণ এ এলাকাটির জন্য প্রয়োজন ছিল সবকিছু বিবেচনায় এনে একটি সুন্দর টেকসই ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা।
ড্যাপের এক হাজার পাতাজুড়ে আছে শুধু কিছু মানচিত্র এবং অনেকগুলো নীতিগত সিদ্ধান্ত; শুধু নেই কোনো ‘প্ল্যান’। এর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হলো জনঘনত্ব কমানোর সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে আরেক দিন লিখব। আগেই বলা হয়েছে, নীতিগত সিদ্ধান্ত ড্যাপের নেওয়ার কথা নয়; এটি শুধু ইউএপিতে তালিকাভুক্ত কৌশলগুলো দিয়ে কীভাবে ওই নীতিগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে কী পদক্ষেপ নেবে একমাত্র তাই দেখাবে। ড্যাপ অন্যের অধিকার ও কার্যক্রম লঙ্ঘন করে তার নিজের এখতিয়ার এবং সুযোগের বরখেলাপ করছে। বরং তার যা করা উচিত ছিল, তা নিয়ে ড্যাপ বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা নেয়নি। ড্যাপ প্রায়ই ২০১৬-৩৫ স্ট্রাকচার প্ল্যানের উদাহরণ দিয়েছে, যার প্রকৃতপক্ষে কোনো আইনি অস্তিত্ব নেই। তবু এই ভৌতিক ‘স্ট্রাকচার প্ল্যান’-টিকেই ড্যাপ বারবার সব সিদ্ধান্তের নির্দেশিকা হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ড্যাপ একটি ভবিষ্যৎ রূপকল্প দিচ্ছে। তবে এ রূপকল্প কার এবং তা কীভাবে বিনির্মিত, তা স্পষ্ট নয়। এটা কি ড্যাপ প্রণয়নকারী দল বা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকল্প পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি, রাজউকের দৃষ্টিভঙ্গি নাকি কোনো আইনপ্রণেতা বা মেয়রের দৃষ্টিভঙ্গি? এটা অবশ্যই আমার দৃষ্টিভঙ্গি নয় এবং সর্বজনীন নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গিও নয়। কারণ যদি তা হয়, তবে আমরা অবশ্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণে রূপকল্প প্রণয়নে অংশগ্রহণ করিনি। একটি শহরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করতে হবে সব অংশীজনের পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে, যার মধ্যে সবার ওপরে হচ্ছে এ শহরের নাগরিকেরা।
সর্বশেষ ড্যাপে যে উদ্দেশ্যগুলো সবার প্রথমেই দেওয়া হয়েছে, তা সবই ওপরের স্তরের পরিকল্পনায় দেওয়া উচিত ছিল, এখানে নয়। এমনকি যদি আমরা মেনেও নিই যে, আমরা প্রস্তাবগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করার জন্য শুরুতে উদ্দেশ্যগুলো তালিকাভুক্ত করব, তবে আমি বলব ড্যাপের উদ্দেশ্যগুলো উল্টো ক্রমে আছে। আবাসন ও বসতি প্রণয়নের শেষ উদ্দেশ্যটি প্রথমেই রাখা উচিত ছিল এবং তারপরে সহনশীল শহর এবং সর্বশেষে উন্নত জীবনমান। আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি কীভাবে বিনিয়োগের স্বাধীনতা প্রথম উদ্দেশ্য হতে পারে, যা আসলে সরকারকে আর রাজউককেও তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়।
বিশ্বে বসবাসযোগ্যতা ও দূষণ সূচকে ঢাকা ধারাবাহিকভাবে তলানিতে রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত করুন জলবায়ু অভিবাসনের ঝুঁকি এবং এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির ব্যাপারটি। সাম্প্রতিক ড্যাপটি নিশ্চিতভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ১৭টি লক্ষ্যের প্রায় কোনোটাই পূরণ করবে না। যেমন, দারিদ্র্য (জি ওয়ান), ক্ষুধা (জি টু), স্বাস্থ্য (জি থ্রি), শিক্ষা (জি ফোর), লিঙ্গ সমতা (জি ফাইভ), বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃ (জি সিক্স), জ্বালানি শক্তি (জি সেভেন), অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জি এইট), শিল্প ও অবকাঠামো (জি নাইন), বৈষম্য (জি টেন), টেকসই শহর (জি ইলেভেন), জলবায়ু (জি থারটিন), জলজ জীবন (জি ফোরটিন), ভূচারী জীবন (জি ফিফটিন), শান্তি ও ন্যায়বিচার (জি সিক্সটিন)। বিধ্বংসী জলবায়ু, দুঃশাসন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন যানজট ও নগরায়ণ এবং গৃহহীনতার কারণে সৃষ্ট আমাদের অস্তিত্বের সংকটের মুখে ড্যাপ একটি কঠিন আঘাত হতে চলেছে।
ড্যাপ সব রোগের মহৌষধ নয়। কিন্তু আমরা ঢাকার নাগরিকেরা কি আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য একটি ন্যায্য, সমসুবিধাসংবলিত, বসবাসযোগ্য এবং টেকসই ভবিষ্যৎ দাবি করতে পারি না?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ এবং সহ–উপাচার্য, আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়