উচ্চমাধ্যমিকে আইসিটি কোর্সের আবশ্যিকতা

উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা—সব বিভাগেই শিক্ষার্থীদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক সভায় আইসিটিকে ঐচ্ছিক করার বিষয়ে আলোচনা হয়; যদিও এ ব্যাপারে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ পর্যায়ে এনসিটিবির মাধ্যমে আইসিটির জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত পর্যালোচকদের সঙ্গেও আলোচনা করে বিষয়টিকে ঐচ্ছিক রাখার ব্যাপারে মতামত আসে।

উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এবং চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও গবেষণায়, এমনকি মানুষের জন্মের পর থেকেও মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে আইসিটির ব্যবহার অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই আইসিটি বিষয়টি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ঐচ্ছিক করার চিন্তা আশঙ্কার; বরং এটিকে শুধু উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়সহ সব বিভাগের জন্য আবশ্যিক করা উচিত।

আমাদের দেশের লেখাপড়া মুখস্থনির্ভর এবং বেশি নম্বর পেয়ে ফল ভালো করার জন্যই সবাই ব্যস্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে লেখাপড়ায় আবশ্যিক বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়, ঐচ্ছিক বিষয়ের ওপরে নয়। এ অবস্থায় আইসিটি বিষয়কে ঐচ্ছিক হিসেবে নিলে শিক্ষার্থীরা ভালো হবে শিখতে পারবে না এবং যথাযথ জ্ঞানের অভাবে আমরা আইসিটিতে পিছিয়ে পড়ব। আমরা এখন যতটুকু তাল মিলিয়ে যাচ্ছি, তা অনেকটাই বিদেশি দক্ষ কর্মীর সহায়তায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় আইসিটিকে প্রাথমিক স্তর থেকেই বাধ্যতামূলক করা।

১৯৬০ সালে ইন্টারনেটের আবির্ভাব ঘটে। তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে সারা বিশ্বে যোগাযোগের গতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অথচ প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাবে আমরা এই প্রযুক্তিতে আসি আরও ৩০ বছর পর। ঠিক একইভাবে, বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবটি মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। সেখানেও কি আমরা যোগ দিতে কালক্ষেপণ করব?

অচিরেই আসছে পঞ্চম শিল্পবিপ্লব, যেখানে মানুষ, প্রযুক্তি, যন্ত্র ও পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করবে। তাহলে এ রকম বহুরূপী ও বহুমুখী ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার প্রাক্কালে আইসিটি কোর্সটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয় কি?

ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়ন ও পরিচালনার পেছনে রয়েছে প্রোগ্রামিং, কোডিং ও অ্যালগরিদম, যা শেখা উচিত প্রাথমিক স্তর থেকেই। সে ক্ষেত্রে এগুলো ধীরে ধীরে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরে অল্প অল্প শিখিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অবশ্যই আবশ্যিক হিসেবে পড়ানো উচিত।

এনসিটিবি এবং সিলেবাস প্রণয়ন কমিটির কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিটি শিক্ষকের বড়ই অভাব। সে কারণে শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে আইসিটি শিখতে পারে না। এ কারণে পরীক্ষায় তারা অকৃতকার্য হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিটি শিক্ষকের অপ্রতুলতা মেটানো সম্ভব সহজেই। দেশে এখন ৫৩টি সরকারি ও ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রতিটিতে সিএসসি বা আইসিটি এবং কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বিষয়েই চার বছরের অনার্স ডিগ্রি দেওয়া হয়। সে হিসাবে গত ২০ বছরে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী আইসিটি গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। এনসিটিবি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নিলে অত্যন্ত ভালো মানের শিক্ষক পাওয়া যাবে, যাঁরা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিক্ষকতা করতে ইচ্ছুক হবেন।

তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটিতে অভিজ্ঞ আইসিটি অধ্যাপক অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাঁদের মতামতকে মূল্যায়ন করা। অবশ্য আইসিটি গ্র্যাজুয়েটদের চাকরিতে পদবি নিয়ে আছে বেশ অসন্তুষ্টি। দীর্ঘকাল যাবৎ আইসিটি ক্যাডার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি দাবি আছে। বিষয়টির যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।

এদিকে কিছু ইতিবাচক ব্যাপারও আছে। অনার্স পর্যায়ে সব বিষয়ে ১০০ নম্বরের আইসিটি কোর্স (আবশ্যিক) প্রবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই কারিকুলাম অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শিক্ষকদের গত জানুয়ারি থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যা চলবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর এসব শিক্ষক নিজ কলেজের অন্য শিক্ষকদের আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন। অন্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সব বিভাগে আইসিটি নামক একটি আবশ্যিক বিষয় পড়ানো হয় অন্তত ১০ বছর যাবৎ। আইসিটি শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের উচ্চশিক্ষায় এটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

তবে এসব জায়গায় আইসিটি যেভাবে গুরুত্বসহ বিবেচিত হচ্ছে, তার সঙ্গে মাধ্যমিক পর্যায়ে আইসিটিকে ঐচ্ছিক হিসেবে জায়গা দেওয়া একটি খাপছাড়া সিদ্ধান্ত হবে। দেশে ভবিষ্যতে যাঁরা কম্পিউটারবিজ্ঞানী, সাইবার সিকিউরিটি, ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডেটা সেন্টার/ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, তাঁদের অবশ্যই উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলক বা আবশ্যিক হিসেবে পড়াশোনা করাই যৌক্তিক। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কাঠামোয় নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে যা করা উচিত, সে বিষয়ে আজকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

  • এম মেসবাহউদ্দিন সরকার অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়