বাংলাদেশে পেশাজীবীদের সমিতি কতগুলো আছে? গুগল করে তার হিসাব পাওয়া গেল না। সব জেলায় যা আছে, তা ধরলে হাজার পার হয়ে যাওয়ার কথা। শুধু প্রধান প্রধান পেশাজীবীদের ধরলেও তা এক শর কম হবে না। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, এই পেশাজীবী সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ পেশার মানুষজনের মুখপাত্র হয়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে?
বলা হয়ে থাকে, এরশাদের পতনের অন্যতম কারিগর ছিল ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ। আগে প্রকৌশলীদের সংগঠন থেকে কোনো কথা বলা হলে অন্তত সরকার শুনত। সাংবাদিকদের ও আইনজীবীদের সংগঠন তো অনেক ভালো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন? আগে এক পেশাজীবী কোথাও আক্রান্ত হলে সারা দেশের সবাই এক হয়ে যেত, এখন একটা দায়সারা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই তাদের কাজ শেষ। বড় জোর একটা মানববন্ধন।
পেশাজীবী সংগঠন এখন আসলে কী করে? তারা দেখানোর চেষ্টা করে, তারা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছে। কিন্তু বেশির ভাগ সংগঠনেই এখন ভোট হারিয়ে গিয়ে সরকারি দলের মানুষজনই ক্ষমতাতে আসীন। বাংলাদেশে যেকোনো সংগঠনের সংগঠকদের প্রধান সমস্যা হলো তাদের ধারণা, সংগঠনের উদ্দেশ্য ১. সরকারের কাছে কিছু দাবি জানানো, ২.সুবিধা আদায়ে সংগঠনের সুবিধা নেওয়া এবং ৩. প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সরকারের পক্ষে কাজ করা। তারা বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করে, পিকনিক করে এবং কিছু প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়—যেগুলো আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পত্রিকার অগুরুত্বপূর্ণ অংশে ছাপা হয়। মাঝেমধ্যে কিছু আর্থিক সাহায্যও করে নিজেদের মধ্যে। আর এর মধ্যেই তাদের গণ্ডি আটকে পড়েছে।
এ রকম হলো কেন? এটা হওয়ার প্রথম কারণ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি। যেহেতু ভোট এখন গৌণ , যারা নেতৃত্বে থাকে, তাদের দরকার হয় জাতীয় নেতাদের আশীর্বাদ। ফলাফল, তারা নিজ নিজ দলের চাওয়ার বাইরে যেতে পারে না। সাধারণদের চাওয়া-পাওয়া তাই গুরুত্ব পায় না। আবার আর্থিক খাতে অস্বচ্ছতা থাকাতে যাদের রাজনৈতিক চাহিদা নেই, তারা নেতৃত্বে আসতে চায় না। আবার নেতাদের অনেকেই সরকারি চাকরি বা সুবিধাযুক্ত কাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের জন্য সরকারের বিপক্ষে যায় এ রকম কিছু করা সম্ভব নয়। সরকারি চাকরিরত হলে সংগঠনের কাজ যদি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তখন তারা সরকারি সিদ্ধান্তেই চলে। কিন্তু এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। আজ থেকে ১৫ বছর আগে পেশাজীবী সংগঠন এ ভূমিকা পালন করলে সেটা ঠিক ছিল, কিন্তু এখন মানুষের চাহিদা অনেক বদলেছে। সুতরাং, সময়ের চাহিদার সঙ্গে পেশাজীবী সংগঠনের বদল এখন সময়ের দাবি।
১) দলীয় রাজনীতি মুক্ত হয়ে সবার আগে পেশাজীবীদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। কেউ আক্রান্ত হলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর তা করার জন্য নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, আর্থিক খাত হতে হবে স্বচ্ছ। তাদের হতে হবে নিজ নিজ পেশার কণ্ঠস্বর।
২) তরুণ পেশাজীবীদের জন্য অনেক কিছু করার আছে। পাস করে বের হয়ে আসার পর তাদের গাইড দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সেমিনার ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা উচিত।
৩) সবাই সরকারি চাকরিতে যেতে পারবে না। আর বেসরকারি চাকরির অনেক তথ্য সবাই পায় না। তাই নিজেদের জন্য প্রযোজ্য সব চাকরির তথ্য দৈনিকভাবে কোনো ওয়েবসাইটে দিলে চাকরি প্রার্থীদের জন্য অনেক সহজ হতো। যেগুলো সার্কুলার হয় না, এমন চাকরির তথ্য যদি নিয়ে আসা যায়, বিশাল বেকার সমাজের উপকার হয়। তাদের কর্মক্ষেত্র তৈরিতেও কাজ করা উচিত।
৪) আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা, কোয়ালিটি সম্পন্ন চাকরি প্রার্থীর অভাব। এটার প্রধান কারণ স্নাতক পর্যায়ের সিলেবাস। নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে সিলেবাসের গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। পেশাজীবী সংগঠকদের প্রধান সুবিধা একাডেমিশিয়ান আর প্রফেশনাল—সবাই একসঙ্গে থাকে। তাই নিজেরা বসে ন্যূনতম গাইডলাইন করে দিয়ে তা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে/সরকারকে করে দিলে তরুণদের জন্য অনেক বড় কাজ হবে। আর অবশ্যই এই গাইডলাইন তিন বছর পরপর রিভিউ করতে হবে।
৫) পেশাজীবীদের সব থেকে বড় সুবিধা নিজেদের মধ্যে কোথায় কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, তারা জানে। তাই আমাদের দেশে যে লাগাম ছাড়া উৎসব চলছে—তার বিপক্ষে যদি শক্ত পদক্ষেপ নেয়, এটা দেশের জন্যই ভালো হবে। আবার মাঝেমধ্যে সরকার অনেক কাজ বা আইন করে যা দেশের বা জনস্বার্থের বাইরে যায়। এই ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নেওয়ার মতো নৈতিক ভিত্তি সব সংগঠনের জন্য থাকা বাঞ্ছনীয়।
৬) নিজ নিজ পেশাসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সরকারকে নীতি প্রণয়নে সাহায্য করা। কোনো নীতি পাশের পূর্বে সরকারের এসব সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে। অথবা কোনো আইন বা নিয়মের ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের দাবি বা পরামর্শ সরকারের বিবেচনা করা উচিত। আবার নিজেদের থেকেই বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশ করে সরকারকে নীতি প্রণয়নে সাহায্য করতে পারে।
৭) আমাদের দেশ গবেষণাতে অনেক পিছিয়ে আছে। পেশাজীবী সংস্থাগুলোর একটা গবেষণা শাখা থাকা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বা গবেষণা সংস্থাগুলো তাদের সহযোগিতা বা আইডিয়া নিয়ে দেশ উপযোগী অনেক গবেষণাকর্ম চালাতে পারে।
আমাদের দেশ এখন একটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ব্যবসায়ী আর তরুণ সমাজের মধ্যেও চলছে হতাশা। এদিকে আমাদের পেশাজীবীদের মধ্যেও আছে অনেক কিছু করার ক্ষমতা—যেহেতু সফল ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, তরুণ সব শ্রেণির মানুষই তাদের সঙ্গে আছে।
আমাদের দেশ এখন একটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ব্যবসায়ী আর তরুণ সমাজের মধ্যেও চলছে হতাশা। এদিকে আমাদের পেশাজীবীদের মধ্যেও আছে অনেক কিছু করার ক্ষমতা—যেহেতু সফল ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, তরুণ সব শ্রেণির মানুষই তাদের সঙ্গে আছে। তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সেরা, তাদেরও আছে নিজস্ব চিন্তা। কিন্তু তারা নিজেরাও নিজেদের সমষ্টিগত সামর্থ্য নিয়ে জানে না। তাই গতানুগতিক কাজের বাইরে বের হয়ে যদি দেশের জন্য কাজ করতে চায়, তা বাংলাদেশকে এগিয়ে দেবেই। সব কাজ কেন আমরা সরকারের জন্য ফেলে রাখব? দেশবদলে সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা রাখে এই দেশ এগোবেই। তবে হ্যাঁ, নিজেদের থাকতে হবে দল নিরপেক্ষ, জনবান্ধব এবং সরকারেরও থাকতে হবে কথা শোনার আর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মেনে নেওয়ার মানসিকতা।
সুবাইল বিন আলম স্থিতিশীল উন্নয়নবিষয়ক কলাম লেখক।
ই-মেইল: subail001@gmail.com