মতামত

মতামত নেওয়ার জন্য জাতীয় তথ্য প্ল্যাটফর্ম কেন জরুরি

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অতি উচ্চ। দীর্ঘদিনের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার পর গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার হঠাৎ পালাবদল জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। দেশবাসীর এই আকাশসম প্রত্যাশা পূরণে ও দেশ পরিচালনায় উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত জনগণের মতামত গ্রহণ করা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা সৎ ও আত্মপ্রত্যয়ী হলেও অনেকের বড় পরিসরে প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। 

কারও কারও আবার মন্ত্রণালয়ভিত্তিক যথাযথ জ্ঞানের স্বল্পতার পাশাপাশি একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ায় প্রশাসনিক কাজে গতিশীলতা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। জনগণের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের এই অভিজ্ঞতার ঘাটতি পূরণের এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি হওয়ার সুযোগ আছে। আর সরকার সে সুযোগ গ্রহণ করতেও ইচ্ছুক। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তো প্রকাশ্যে বলেছেন রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সরকারের কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তা ধরিয়ে দিতে। এটা প্রকারান্তরে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত গ্রহণেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে জনগণের মতামত কীভাবে কার্যকরভাবে ধারণ করা যায়, তা ভাবতে হবে।

জনগণের মতামত ধারণ, সেগুলোর বিন্যাস ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা গ্রহণ করার জন্য দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। উল্লেখ্য, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ‘যোগাযোগ ও মতামত’ হেডারে ‘আপনার জিজ্ঞাসা’ নামে যে বাটন রয়েছে, সেখানে ক্লিক করে নাম ও ই–মেইল আইডি লিখে মতামত লিখে পাঠানোর সুযোগ আছে। আবার তথ্য কমিশনের ওয়েবসাইটে অনুরূপভাবে মতামত পাঠানোর সুযোগ আছে। 

কিন্তু এসব ওয়েবসাইট কতটুকু কার্যকরভাবে পরিচালনা করা হয়, তা জানা নেই। তা ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য জনগণের চাহিদামতো তথ্য প্রদান করা। তাই জনগণের মতামত ধারণ এবং তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করার ব্যবস্থা থাকার কথা নয়। আবার অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থারও ঘাটতি আছে।

অন্যদিকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে পাবলিক রিলেশনস অফিসার (পিআরও) থাকলেও কোনো তথ্য বিশ্লেষণ ইউনিট নেই, যেখান থেকে ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত এবং ইলেকট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান অবস্থায় জনসংযোগ কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তর–সম্পর্কিত সংবাদগুলো এবং মতামত হয়তো মন্ত্রী, সচিব কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নজরে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু যথাযথ বিন্যাস ও বিশ্লেষণ করে তা জনগণের কল্যাণে নীতি গ্রহণের লক্ষ্যে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার সুযোগ কম।

তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ, নিজেদের জবাবদিহি করা এবং দেশ পরিচালনায় উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য একটি জাতীয় তথ্য প্ল্যাটফর্ম গঠন করুন, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে ফোন, চিঠি এবং ই–মেইলসহ বিভিন্ন উপায়ে মতামত পাঠানোর সুযোগ পাবে। এই তথ্য প্ল্যাটফর্মটি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের অধীন থাকতে পারে। পাশাপাশি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তাকে (পিআরও) কেন্দ্র করে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক একটি শক্তিশালী তথ্য বিশ্লেষণ ইউনিট গঠন করুন। 

এই প্ল্যাটফর্ম ও ইউনিটগুলো ফোন, চিঠি এবং ই–মেইলের মাধ্যমে সরাসরি প্রাপ্ত এবং ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত ও ইলেকট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য বিশ্লেষণ করে নিয়মিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে, যেন নীতিনির্ধারণী মহল জনগণের কল্যাণে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। পাশাপাশি বিশ্লেষণকৃত মতামতের নির্যাস এই প্ল্যাটফর্ম এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ওয়েবসাইটে নিয়মিত প্রকাশ করবে, যাতে জনগণ বুঝতে পারে যে সরকার তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সরকারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি জনতুষ্টি অর্জন ও জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ আছে। 

সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে জনগণের মতামত সংসদে তুলে ধরার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশে তার চর্চা কতটুকু হয় তা কারও অজানা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এবং বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় জাতীয় সংসদে জনগণের মতামত পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে এমন নজির নিশ্চয়ই বেশি পাওয়া যাবে না। রং আমাদের জাতীয় সংসদের বেশির ভাগ অধিবেশনে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থই বেশি প্রতিফলিত হয় কিংবা উন্নয়নের ডামাডোলের খিস্তিখেউড় প্রতিধ্বনিত হয়। 

তাই মতামত গ্রহণের জন্য স্থায়ীভাবে একটি জাতীয় তথ্য প্ল্যাটফর্ম গঠন করলে অন্তর্বর্তী সরকারের পরে অন্য নির্বাচিত সরকারের দেশ পরিচালনার সময়ও জনগণের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকবে। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এই সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণে অগ্রগামী হবে।


ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক