সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাশালী ‘নারী’ কর্মকর্তাদের আচরণ এবং ‘স্যার’ সম্বোধন নিয়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে বলছেন, নারীদের ‘স্যার’ সম্বোধন আসলে লিঙ্গসমতার একটি ভালো উপায়, আরেক দল বলছেন, এটি অত্যন্ত আপত্তিকর। একটি প্রশ্ন এখানে করা দরকার: বাংলাদেশে নারী পেশাজীবীদের ‘সম্মান’ নিশ্চিত করতে ‘স্যার’ সম্বোধন কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল?
আসলেই অনেক নারী পেশাজীবীকে দেখেছি তাঁরা স্যার সম্বোধিত হলে খুব খুশি হন, বিশেষ করে তাঁরা যদি প্রশাসনিক পদে আসীন থাকেন। গত কয়েক বছরে নারী শিক্ষিকদের স্যার বলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে গেছে। আমি নিজেই এর ভুক্তভোগী। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অধিবেশন পরিচালনাকালে আমাকে বারবার প্রশিক্ষণার্থীরা স্যার বলে সম্বোধন করছিলেন। আমি সোজাসাপটা বলে দিয়েছিলাম, আমাকে নাম ধরে ডাকতে। তারপরও আমাকে স্যার ডাক শুনতে হয়েছিল।
পেশাগত সম্বোধনের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য কেবল স্যার-ম্যাডাম ডাকায় সীমাবদ্ধ নয়। লক্ষণীয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নারী শিক্ষিকদের অনেক সময় আপা বলে ডাকলেও পুরুষ শিক্ষকেরা কখনোই ভাই হন না, অন্তত আমি এমনটি হতে দেখিনি। বাংলাদেশে নারীদের আপা ডাকার ব্যাখ্যা হলো—নারী কোমল, স্নেহময়ী, কাছে টেনে নেন। এর মাধ্যমে যেমন একদিকে নারীত্বের একটা স্টেরিওটাইপ তৈরি হয়, অন্যদিকে নারী পেশাজীবীদের পেশাদার গাম্ভীর্যকে লঘু করা হয়—কিছুটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো।
বাংলাদেশে নারীমাত্রই স্যার হতে চান না। পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে আপনি নারী না পুরুষ, তার সম্পর্ক নেই। একজন পুরুষ নারীবাদী মানুষ হতে পারেন, আবার একজন নারী পুরোদস্তুর পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী হতে পারেন। আমি এবং আমার মতো অনেকেই মনে করেন না যে স্যার না হলে আমাদের সম্মান কমে যাবে, কারণ আমরা পুরুষকে সামাজিক সম্মানের মানদণ্ড মনে করি না। কাজেই, যেসব পুরুষতান্ত্রিক নারীরা সেভাবে ভাবেন, তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আলাদাভাবে বিবেচনার দাবি রাখে, এখানে অতিসরলীকরণ এবং অতিসাধারণীকরণ করা যাবে না।
একটি সমাজের আচার–আচরণ, প্রথা এবং লৈঙ্গিক সমীকরণ—সবকিছুই ওই সমাজের শব্দের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। ইতিহাস জানায়, প্রথাগতভাবে রাষ্ট্রীয় পদের অনেক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে নারীরা অনুপস্থিত ছিলেন, কাজেই বাংলা ভাষায় এসবের লিঙ্গহীন শব্দের অভাব আছে। যেমন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সচিব প্রভৃতি। এখন কোনো নারী যখন তীব্র প্রতিযোগিতা পার করে এই ক্ষমতাবলয়ের ভেতরে ঢোকেন, তখন কিন্তু তাঁর লড়াই শেষ হয়ে যায় না। একজন নারী বিচারককে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যেতে হয়, তিনি আইনের বিশ্লেষণে পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে দুর্বল নন, বা তিনি ‘আবেগের বশবর্তী হয়ে’ রায় লেখেন না। একজন নারী পেশাজীবীকে প্রতিনিয়ত মাথায় রাখতে হয়, কোনো পরিস্থিতিতে পুরুষ সহকর্মী কেমন আচরণ করবেন এবং সে অনুযায়ী তিনি আচরণ করার চেষ্টা করেন।
পুরুষতান্ত্রিক ইকোসিস্টেমে টিকে থাকতে হলে অনেক নারীকে মানসিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠতে হয়। তাঁদের কাছে ‘স্যার’ ডাক আসলে নিজেদের পদমর্যাদা নিশ্চিতের প্রথম ধাপ। পুরুষ সহকর্মীর সদৃশ সম্বোধনের মাধ্যমে একটা আপাতসমতা আসছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
কিন্তু সমাজ যেহেতু নারী আর পুরুষকে একই মাপকাঠিতে দেখতে চায় না, কাজেই নারী পেশাজীবী ‘পুরুষালি’ আচরণ করলেও সেটা দোষ হয়। আবার পুরুষের মতো আচরণ না করে নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে চললেও তাঁদের কথা শুনতে হয়। যেমন আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন (নারী) ডিনের কাছে শুনেছি, তিনি বিভিন্ন মিটিংয়ে আলোচ্য বিষয়ের বাইরে খুচরা আলাপ করতেন না। এর ফলে তাঁকে অন্য পুরুষ ডিনরা রাশভারী এবং গম্ভীর হওয়ার অপবাদ দিয়েছিলেন। নারী পেশাজীবীদের এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনা না করলে কেন তাঁরা ‘স্যার’ হতে চান, তা বোঝা যাবে না।
কর্মকর্তাদের এ রকম আচরণ আসলে আমাদের ঔপনিবেশিক আইনের ফলাফল। দুটি বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হলেও আমাদের দেশের আইনি এবং প্রশাসনিক কাঠামো এখনো ব্রিটিশ আমলের আইন দ্বারা পরিচালিত। ফলে আমাদের প্রশাসনিক অনেক কাজকর্মে ঔপনিবেশিক হাবভাব চলে আসে, যেমন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধনের ওপর জোর দেওয়া, নিজেদের অন্যায় বা অসদাচরণ অস্বীকার করে জনগণকে অপমান করা বা তাদের ওপর দায় চাপানো ইত্যাদি।
এক. ফুকোর গভর্নমেন্টালিটি মতবাদ সাহায্য করবে। সরকার তার কাজ আদায়ের জন্য এমন কিছু টুল বা কৌশল অবলম্বন করে, যার মাধ্যমে অবচেতনভাবে শাসিত জনগণ ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যেমন আমাদের দেশে প্রচলিত বদলির শাস্তি। পেশাগত অসদাচরণের ক্ষেত্রে অনেককেই বদলি করা হয়। আদতে এটি কিন্তু কোনো শাস্তি না। কারণ, এতে ওই কর্মকর্তার কোনো বঞ্চনা হয় না। এ ব্যবস্থার উৎস ব্রিটিশ প্রশাসন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে নেটিভ এবং শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের আলাদাভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। এই শাসনপদ্ধতিকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ‘ঔপনিবেশিক পার্থক্যের শাসন’ (দ্য রুল অব কলোনিয়াল ডিফারেন্স)। নেটিভ ভারতীয়রা স্বভাবগতভাবে সাহেবদের চেয়ে বেশি দুর্নীতিপরায়ণ, এ বিশ্বাস থেকেই বদলিকে একটি প্রথা হিসেবে গড়ে তোলা হয়, যাতে কোনো ভারতীয় এক স্থানে বেশি দিন থেকে জনমত নিজের অনুকূলে না আনতে পারেন। এই আমলাতান্ত্রিক প্রথা পরে আমাদের দেশে সুদৃঢ়ভাবে গেড়ে বসে।
দুই. আইনের পজিটিভিস্ট ব্যাখ্যা যেখানে আইনের ক্লাসে প্রথমেই শেখানো হয় আইন হলো সার্বভৌমের আদেশ। এর ফলে আইনের ব্যাখ্যা আর প্রয়োগ আমাদের বিচার ও প্রশাসনের কাছে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যেখানে সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনা আসে তাত্ত্বিক নীরস ব্যাখ্যার পরে।
দুঃখের কথা হলো, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হলেও আমাদের দেশের আইনি এবং প্রশাসনিক কাঠামো এখনো ব্রিটিশ আমলের আইন দ্বারা পরিচালিত। ফলে আমাদের প্রশাসনিক অনেক কাজকর্মে ঔপনিবেশিক হাবভাব চলে আসে, যেমন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধনের ওপর জোর দেওয়া, নিজেদের অন্যায় বা অসদাচরণ অস্বীকার করে জনগণকে অপমান করা বা তাদের ওপর দায় চাপানো ইত্যাদি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, স্যার সম্বোধন বদলালেই কি ঔপনিবেশিক পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বদলে যাবে? না। কিন্তু ভাষার ব্যবহার মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
আজকাল ভাষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে যখন নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, অথবা পুংলিঙ্গ শব্দ বাদ দিয়ে পুরুষ বা নারী কোনোটাই নয়—এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, দুই রকম ফলাফল হচ্ছে—১. অবচেতনভাবে নারীবাচক শব্দকে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে; ২. পুংলিঙ্গকে মানদণ্ড হিসেবে ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে নারীবাচক অবস্থানকে পুরুষের চেয়ে হীন প্রমাণ করা হচ্ছে।
ইংরেজি স্পাউসের আদলে কোনো উভয়লিঙ্গ শব্দ বাংলায় নেই। বাংলা স্বামী শব্দটি কেবল একজন নারীর বিবাহিত পুরুষ সঙ্গী বোঝায় না। স্বামী শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কর্তা বা মালিক অর্থাৎ একটি অধিকারগত ক্ষমতা জড়িত। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘হাজবেন্ডকে’ নারীর কর্তা হিসেবেই দেখা হয়। কাজেই যত দিন পর্যন্ত স্পাউসের মতো কোনো লিঙ্গবৈষম্যহীন শব্দ বাংলায় না আসবে, তত দিন আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব থেকে বঞ্চিত হব। স্যার/ম্যাডাম এসব কলোনিয়াল শব্দের পরিবর্তে আমাদের নিজস্ব শব্দ খুঁজে বের করতে হবে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে শব্দের ব্যবহার জরুরিভাবে সম্পৃক্ত। স্যার বললে কেবল নারী না, লিঙ্গবৈচিত্র্যময় মানুষেরাও বৈষম্যগ্রস্ত হন। লিঙ্গ বৈচিত্রময় মানুষদের নানা পরিচয় আছে, যেমন লিঙ্গ রূপান্তরকামী মানুষ, ট্রান্স নারী, ট্রান্স পুরুষ, জেন্ডার ফ্লুয়িড মানুষ, ননবাইনারি মানুষ, হিজড়া এবং আরও অনেকে। সবাইকে গণহারে স্যার বললে তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকারকে অপমান করা হয়।
অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, নিজ কর্মগুণে কেন নারী নিজের নারীত্বকে অহংকারের বিষয় করে তোলে না? নারী একা কেন, যেকোনো লিঙ্গপরিচয়ের মানুষেরই নিজ নিজ কর্মবলে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সমাজ যখন একজন পুরুষ অধ্যাপক আর নারী অধ্যাপকের কাজকে একই মানদণ্ডে মানতে চায় না, সমাজ যখন একজন হিজড়া দোকানদারের কাছ থেকে জিনিস কিনতে চায় না, তখন আমাদের বাধ্য হয়ে এসব শব্দের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে কথা বলতে হয়।
অর্পিতা শামস মিজান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক