স্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পিটার পেল্লেগ্রিনির জয় ইউরোপে অতি ডানপন্থীদের বিজয়ের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। স্লোভাকিয়ায় প্রেসিডেন্ট পদটি আলংকারিক। এরপরও পেল্লেগ্রিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপপন্থী প্রার্থী ইভান করককের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে খুব স্বচ্ছন্দে জয়ী হয়েছেন। তাঁর এই বিজয় প্রধানমন্ত্রী রবার্টো ফিকোর ক্ষমতাকে আরও সংহত করল। এর ফলাফল হলো, ইউরোপে ভ্লাদিমির পুতিনের সমর্থক রাজনীতিবিদদের বিজয় বাড়ছেই।
ইউরোপজুড়ে অতি ডানপন্থীদের প্রতি জনসমর্থন ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে। নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগালের জাতীয় নির্বাচনে অতি ডানপন্থী দলের ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে। জার্মানির স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে; অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামে পার্লামেন্ট নির্বাচন এ বছরেই। তিনটি নির্বাচনের আগে জরিপ বলছে, অতি ডানপন্থীদের ভোট বাড়বে।
অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে পুতিনের সমর্থনপুষ্ট ফ্রিডম পার্টি যদি আরেকটি দলকে জোটে টানতে পারে, তাহলে দেশটিতে অতি ডানপন্থী দলটির ক্ষমতায় ফেরার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ইউরোপজুড়ে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে অতি ডানপন্থী দলগুলোর পালে জোর হাওয়া এসে লেগেছে এবং তারা তাদের প্রথাগত কট্টর সমর্থকদের বাইরেও ভোটার টানতে পারছে।
এই প্রবণতা যে বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসছে, তা হলো, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে জুন মাসের ভোটে দুটি অতি ডানপন্থী অংশের অংশীদারত্ব বাড়বে। রাশিয়া ইস্যুতেই অতি ডান এই দুই পক্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য দেখা যায়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বাধীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অতি ডানপন্থী ইউরোপিয়ান কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফরমিস্ট (ইসিআর) গ্রুপ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে সমর্থন দেয়।
অন্যদিকে অতি ডানপন্থী আইডেনটিটি ও ডেমোক্রেসি গ্রুপ (জার্মানির ফুর ডয়েচেল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি) রাশীয়াপন্থী গ্রুপ। তারা পদ্ধতিগতভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
জুনের নির্বাচনে অতি ডানপন্থী দুটি গ্রুপের আসন বাড়ছে বলে পূর্বাভাসে জানা যাচ্ছে। দ্বিতীয় গ্রুপটির আসন বাড়ার কারণে তাদের সামনে কেবল ইউরোপ পিপলস পার্টি (ইপিপি) এবং বামপন্থী সোশ্যালিস্ট ও ডেমোক্রেটরা থাকবে। এর অর্থ হচ্ছে, এবারে শুধু অতি ডানপন্থীদের আসন বাড়বে না, পুতিনপন্থী অতি ডানপন্থীদেরও সংখ্যা বাড়বে।
অস্ট্রিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সম্প্রতি ফাঁস করেছেন, রাশিয়া এরপর ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো সদস্য অথবা ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত কোনো রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এমন একটা দৃশ্যের কথা কল্পনা করুন তো?
প্রথাগত নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি পর্দার আড়ালে জোট ভেঙে জোট গড়তে ঘোড়া বেচাকেনার কিছু প্রচেষ্টাও চলছেও। ইউরোপীয় কমিশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন ইউরোপ পিপলস পার্টির প্রার্থী। অথচ তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনির পাণিপ্রার্থনা করছেন। উরসুলা আশা করছেন, ইতালির এই অতি ডান নেতার দল ব্রাদার্স অব ইতালি প্রথাগত জোট ইসিআর ছেড়ে ইপিপির সঙ্গে জোট বেঁধে তার ভোটের সংখ্যা বাড়াবে।
অন্যদিকে ২০২১ সালে ইপিপি জোট ছাড়ার পর ভিক্তর অরবানের ফিদেজ দলের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটাও আসন নেই। এবার তারা ইসিআর জোটে যুক্ত হতে চাইছে, যাতে তাদের আসন নিশ্চিত করা যায়।
এই নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ? ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সামনে প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। ইউক্রেনের জন্য সামরিক সমর্থন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ, সবুজ রূপান্তর—এই তিনটি বিষয়ই মূল চ্যালেঞ্জ। পুতিনের প্রতি সহানুভূতিশীল অতি ডানপন্থী শিবিরের বাড়বাড়ন্ত এই অ্যাজেন্ডাগুলোর সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
এর মধ্যে ইউক্রেন অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কেননা, ইউক্রেনকে পরবর্তী আর্থিক, সামরিক ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে দেশটিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় নিয়ে অস্বস্তিকর আলোচনা চলছে। ভন ডর লেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে তার শীর্ষ অগ্রাধিকারের বিষয় হবে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা। কিন্তু পুতিনের প্রতি অনুগত সদস্যসংখ্যা বাড়লে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ও ইউরোপিয়ান কাউন্সিল—দুই জায়গাতেই সেটা করা কঠিন হবে।
পালা অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ছয় মাসের জন্য ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে হাঙ্গেরি। এর মধ্যে হাঙ্গেরি ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা প্রস্তাব আটকে দিয়েছে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবে বাধা দিয়েছে।
ওরবান হলেন ইউরোপে পুতিনের পুতুল। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে সার্বিয়ার অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করছেন। সার্বিয়াতেও হাঙ্গেরির মতো পুতিনপন্থী সরকার রয়েছে। পশ্চিম বালকানের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সার্বিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
পুতিনপন্থী হোক আর পুতিনবিরোধী হোক, ইউরোপজুড়ে অতি ডানপন্থীদের এই অগ্রযাত্রায় একটা বিষয় পরিষ্কার যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভেতর থেকে ফাঁকা করে দিতে তাদের অবস্থান সংহত করা প্রয়োজন। রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির পথ খুঁজতে কিছু পক্ষ সেটা করতে খুবই উৎসাহী। তারা সব ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি বয়ে নিয়ে আসছে।
অস্ট্রিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সম্প্রতি ফাঁস করেছেন, রাশিয়া এরপর ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো সদস্য অথবা ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত কোনো রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এমন একটা দৃশ্যের কথা কল্পনা করুন তো?
আরমিডা ভন রিজ, চ্যাটাম হাউসে ইউরোপ কর্মসূচির নেতৃত্বে রয়েছেন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত