ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় ঢাকায়। এতে অনেক এলাকা ও রাস্তা তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় নাকাল হন নগরবাসী।
ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় ঢাকায়। এতে অনেক এলাকা ও রাস্তা তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় নাকাল হন নগরবাসী।

ঢাকার জলাবদ্ধতায় কার দায় কতটা

শুক্রবার (১২ জুলাই) সকালে ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় ঢাকায়। এতে অনেক এলাকা ও রাস্তা তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় নাকাল হন নগরবাসী। গাড়িচালকেরা বের হতে পারছিলেন না, বের হলে ইঞ্জিন বিকল হচ্ছিল।

এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী কে? এ প্রশ্ন করলে সবাই সোজা উত্তর দেবে। বলবে, এটার জন্য সরকার দায়ী। সরকার তো সবকিছুর জন্যই দায়ী। সেটা তো মোটা আলাপ। সে দায় নাহয় সরকার নিল। কিন্তু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে মূলত জলাবদ্ধতা দূরীকরণ কার কাজ? এটার জন্যও সবাই ‘কেষ্টা বেটা’র নাম বলবে। সিটি করপোরেশন। হ্যাঁ, সিটি করপোরেশনের কাজই বটে। জলাবদ্ধতার জন্য সিটি করপোরেশন তার দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু জলাবদ্ধতা দূরীকরণ সিটি করপোরেশনের কাজ—এ কথা বলে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে হবে না।

আমি বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করতে চাই। বলতে চাই, জলাবদ্ধতার জন্য আমি ও আপনি দায়ী। তথা আমরা দায়ী। এই ‘আমরা’ কারা? এই আমরা হলাম যারা বাসার ময়লা–আবর্জনা যথাযথভাবে ডাস্টবিনে ফেলি না, যারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য যথানিয়মে ডিসপোজিবল ব্যাগে করে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে ফেলি না, যারা কারখানার বর্জ্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্গমনের ব্যবস্থা করি না, যারা বাড়ি করার সময় ড্রেনের পর্যাপ্ত জায়গা ছেড়ে দিই না, যারা বাড়ির পয়োনিষ্কাশনের সেপটিক ট্যাংকের লাইন সিটি করপোরেশনের নালায় সংযোগ দিয়ে দিই, যারা নাগরিক হিসেবে, ব্যবসায়ী হিসেবে বা অন্য কোনো পেশার নাগরিক হিসেবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মৌলিক নির্দেশনা মানি না। বিশেষ করে যারা বাড়ি নির্মাণের সময় ইট, সুরকি, বালু বা ইত্যাকার আবর্জনা নালায় বস্তায় ভরে ফেলে দিই, তারা এ দায় এড়াতে পারি না।

যারা বাসায় ময়লায় ভরা পলিথিনের ব্যাগটি ডাস্টবিনে না ফেলে বা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত সংগ্রহকারীকে না দিয়ে নালায় ছুড়ে ফেলে—এ সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। তা ছাড়া মেগা প্রজেক্ট ও বড় প্রকল্পের উন্নয়নকাজ চলাকালে ঠিকাদারদের তাঁদের মালামাল, ইট–সুরকি ও বর্জ্য যথানিয়মে না রেখে নালা ব্লক করে রাখতে দেখা যায়।

সবাই যদি এ অনিয়মগুলো না করত, তবে কোনোভাবেই জলাবদ্ধতা হতো না বলে আমি মনে করি। আমরা এ অন্যায়গুলো না করলে যদি জলাবদ্ধতা হতো, তবে সিটি করপোরেশনকে এককভাবে দায়ী করা যেত। তবে কি সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে। কারণ, এটাই তাদের মূল কাজ। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মেয়র–কাউন্সিলররা কাজ করবেন এবং সিটি করপোরেশনের সব কর্মকর্তা–কর্মচারী কাজ করবেন, যেন জলাবদ্ধতা না হয়। সে ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ, সে ধরনের দক্ষ ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন দরকার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁদের নির্বাচিত করা হয়, তাঁদের কি সে ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণের সক্ষমতা আছে? যেসব কর্মচারী নিয়োগ করা হয়, তাঁদের কি সে রকম বাস্তবায়ন–সক্ষমতা আছে? যদি না থাকে, তবে এ জন্য কারা দায়ী? যারা ভোট দিয়ে বা ভোটের আয়োজন করে নির্বাচিত করে তারা দায়ী, আর যারা যথানিয়মে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রদান করে না, তারা দায়ী। সেই তারা কারা?

এমনকি রিয়েল এস্টেট ও শিল্পকারখানার মালিকদের দায়ও অনেক। বিশেষ করে যাঁরা বিদ্যমান নদী, খাল, লেক ও পুকুরগুলোকে বেদখল করছেন বা সংরক্ষণের কার্যকর চেষ্টা নিচ্ছেন না, তাঁরাই মূল নিয়ামক হতে পারতেন। বলা যায়, নগরীতে একমাত্র সিটি করপোরেশনই পরিচ্ছন্নতা বা নালা ব্যবস্থাপনায় কাজ করে, আর বাকি সব স্টেকহোল্ডার তথা আমরা সবাই কেবল ময়লা ফেলি, যত্রতত্র বর্জ্য ফেলি, জলাশয় বেদখল করি, অনিয়মে মত্ত থাকি।

সেই তারাও আমরাই। হয় রাজনীতিবিদ, না হয় আমলা; হয় বিজনেস এলিট, না হয় জনপ্রতিনিধি কিংবা অন্য সব পেশাজীবী, যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকায় যথাযথ নির্বাচন হয় না, যথাযথ নিয়োগ পরীক্ষা হয় না, তারা দায়ী। আর দায়ী তারা, যারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপসহীন ভূমিকা পালন করতে পারে না।

জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি কার কর্মফল, সেটাও একটু নিজের আয়নায় দেখে নেওয়া ভালো। যেমন আমাদের বাচ্চারা জলাবদ্ধতার কারণে স্কুলে যেতে পারছে না বা পরীক্ষা দিতে পারছে না। বাচ্চারা কি স্কুলে বা বাইরে চিপস খেয়ে বা পানি খেয়ে চিপসের প্যাকেট বা বোতলটি যথাস্থানে রাখে, নাকি ছুড়ে ফেলে? হাসপাতালের ভেতরে জলাবদ্ধতা, রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারছে না। প্রতিটি হাসপাতাল কি মেডিকেল বর্জ্য আলাদা ডিসপোজ যথানিয়মে করে, নাকি সব প্লাস্টিক মেডিকেল বর্জ্য নালায় ছেড়ে দেয়?

জলাবদ্ধতায় তলিয়ে গেছে সব ফুটপাতের দোকান ও তাদের মালামাল। প্রত্যেক দোকানদারের লাখ লাখ টাকা ক্ষতি। ডাব ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কাপড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত ফুটপাতের দোকানদারদের কয়জন যথানিয়মে বর্জ্য সংগ্রহ করে ও ডাস্টবিনে নিয়ে ফেলে? চাকরিপ্রার্থীরা জলাবদ্ধতায় নাকাল। প্রতিটি চাকরির পরীক্ষার পর কেন্দ্র ও আশপাশের সব রাস্তায় যে পরিমাণ প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্য ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে থাকে, তা দেখলেই বোঝা যায় যে এসব চাকরিপ্রার্থী ও তাঁদের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা এসব ফেলে গেছেন। এসব ময়লার বেশির ভাগ যায় নালায়।

এ রকমভাবে নাগরিকদের মধ্যে আরও অনেক স্টেকহোল্ডার পাওয়া যাবে, যারা জলাবদ্ধতার ভুক্তভোগী। আবার একই সঙ্গে তারাই তাদের কর্ম দিয়ে নিজেদের এ নাজেহাল অবস্থায় ফেলেছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের দায় কেবল সিটি করপোরেশনকে না দিয়ে, বরং রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।

এমনকি রিয়েল এস্টেট ও শিল্পকারখানার মালিকদের দায়ও অনেক। বিশেষ করে যাঁরা বিদ্যমান নদী, খাল, লেক ও পুকুরগুলোকে বেদখল করছেন বা সংরক্ষণের কার্যকর চেষ্টা নিচ্ছেন না, তাঁরাই মূল নিয়ামক হতে পারতেন। বলা যায়, নগরীতে একমাত্র সিটি করপোরেশনই পরিচ্ছন্নতা বা নালা ব্যবস্থাপনায় কাজ করে, আর বাকি সব স্টেকহোল্ডার তথা আমরা সবাই কেবল ময়লা ফেলি, যত্রতত্র বর্জ্য ফেলি, জলাশয় বেদখল করি, অনিয়মে মত্ত থাকি।

সবাই নষ্ট করলে আর একজন কাজ করলে তো নগরী সুন্দর হবে না, জলাবদ্ধতামুক্ত হবে না।

● ড. সফিকুল ইসলাম স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিশেষজ্ঞ