মতামত

‘অপ্রতিরোধ্য’ ছাত্রলীগকে ঠেকাবে কে 

ছাত্রলীগের নির্যাতনের প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ১৬ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

শুক্রবার দুপুরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার কয়েকজন নেতা প্রথম আলো অফিসে এসেছিলেন। তাঁরা বললেন, সেখানে ছাত্রলীগের নামে যে শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা নিগ্রহ, সিট-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে, তাঁরা তা সমর্থন করেন না। তাঁরা চান সেখানে ছাত্রলীগ সুস্থ ছাত্ররাজনীতি করুক, সংগঠনের দুর্নাম হয় এমন কিছু না ঘটুক। কিছুটা অবাক হলাম। সাধারণত এক ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অপর সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে এসব কথা বলেন। জিজ্ঞেস করি, কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছেন কি না। বললেন, জানিয়েছেন। 

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলে একজন ছাত্রীর ওপর সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনায় উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। সংবাদমাধ্যমে নির্যাতনের যেসব বর্ণনা এসেছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, এটি বর্বর ও কুরুচিপূর্ণ ঘটনা। অথচ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানকার প্রশাসন অনেকটা নির্বিকার। দায়সারা তদন্ত কমিটি করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। আর শিক্ষকদের মনোভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা বিবেক দ্বারা চালিত নন, ছাত্রলীগ দ্বারা তাড়িত। 

বুধবারই প্রথম আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি তৌহিদী হাসান কথা বলেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রীর সঙ্গে, যিনি ক্যাম্পাসে থাকা নিরাপদ মনে না করে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে থাকেন। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেত্রী তাবাসসুম ইসলাম নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে থাকেন। এ সময় ওই ছাত্রী হাত তোলেন। হলে ওঠার বিষয়টি আগে তাবাসসুমকে না জানানোয় চটে যান তিনি। এ ঘটনার জেরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে হলের গণরুমে (দোয়েল) তাঁকে ডেকে নেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল তাঁকে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন করেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে চালাচ্ছিল শারীরিক নির্যাতন। কিলঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে ঊরুতে ফুটাচ্ছিল।’

 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিগ্রহের শিকার মেয়েটির নিরাপত্তা দেয়নি। এমনকি বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তিনি গ্রামের বাড়িতে কেমন আছেন, সেই খোঁজও নেয়নি তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেছেন, মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে কিংবা আশপাশের কোথাও বসবাস করলে তাঁরা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেবেন। মেয়েটি যখন সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন, তখন তাঁরা কোথায় ছিলেন?  

বুয়েটে আবরার ফাহাদের হত্যার পর আমরা ভেবেছিলাম, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থামবে। এরপর কুয়েটে এক শিক্ষককে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মারামারি থামছেই না। বেশ কয়েক বছর আগে সেখানে এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। তাঁর মা দীর্ঘদিন ঘাতকদের বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিচার পাননি। বিচার পাননি আরও অনেক সন্তানহারা মা–বাবা। 

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, বর্তমানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটির যিনি সভাপতি, ফয়সাল সিদ্দিকী ওরফে আরাফাত ক্যাম্পাসে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে ২০১৬ সালে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ২০২২ সালে তিনি পুনর্বাসিত হন। অভিযুক্ত সানজিদা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি এবং সভাপতি গ্রুপের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

 বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন আক্রান্ত ছাত্রীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, যখন ক্ষমতাসীন দলটি নির্বিকার, তখন উচ্চ আদালত এগিয়ে এসেছেন। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছেন, ছাত্রী হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন, শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ছাত্রলীগের যে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নির্যাতনে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে হবে। ওই ঘটনাকে খুবই অ্যালার্মিং (উদ্বেগজনক) বলে অভিহিত করেছেন আদালত। 

আদালতের এ আদেশের পর ছাত্রলীগের অভিযুক্ত নেত্রী সানজিদা চৌধুরী ও তাবাসসুম ইসলাম ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। তাঁরা ওই ভুক্তভোগীকে এই বলে শাসিয়েছিলেন যে নির্যাতনের কথা কাউকে জানালে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া এখন ছাত্রলীগের নিজস্ব সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায়ের লিখিত অভিযোগ অনুযায়ী, ‘গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলামের সাত থেকে আটজন অনুসারী আমার রুমে এসে আমাকে বের হয়ে যেতে হুমকি দেন। আমি রাজি না হলে আমার বিছানা ফেলে দিয়ে আরেকজনকে তুলে দেন তাঁরা। এ সময় সোলাইমান নামের ছাত্রলীগের এক নেতা আমাকে মারধর করেন। এরপর আমাকে সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলামের রুমে নিয়ে মারধর ও মানসিক নির্যাতন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম বলেন, “তোকে মেরে শিবির বলে চালিয়ে দেব।” কিন্তু আমি হিন্দু জানার পর বলেন, “এখন তো তোকে মেরে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না।”’

সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে চার ছাত্রকে পর্যায়ক্রমে পেটানো হয়েছিল ছাত্রশিবির সন্দেহে। এতে নেতৃত্ব দেন চমেক শাখা ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতা-কর্মীরা। চারজনই চমেকের ৬২তম ব্যাচের এমবিবিএসের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, যঁারা মারধর করেছেন, তঁাদের নাম বললে ওই চার ছাত্রকে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। 

অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের অসাম্প্রদায়িক নেতাই বটে! ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মন্দির ভাঙচুরের কারণে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হন। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হল শাখার সাধারণ সম্পাদক বলেন, মেরে ফেললে কেউ কিছু করতে পারবে না। অসাম্প্রদায়িকতা গঠনতন্ত্র দিয়ে প্রমাণ করা যায় না, প্রমাণ করতে হয় আচরণ দিয়ে। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যখন ছাত্রলীগের ভয়ে কম্পমান, প্রশাসন নির্বিকার, তখন ‘সারা দেশে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নিপীড়নের’ প্রতিবাদে অনশনে বসেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে জোহা চত্বরে অনশন করেন তিনি। তাঁর পাশে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন।’

বুধবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ফরিদ উদ্দিন খান ফেসবুকে অনশনের ঘোষণা দিয়ে লেখেন, ‘দেশজুড়ে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর একের পর এক যে নিপীড়ন আর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তা রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘন। একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমি ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন।’ 

বুয়েটে আবরার ফাহাদের হত্যার পর আমরা ভেবেছিলাম, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থামবে। এরপর কুয়েটে এক শিক্ষককে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মারামারি থামছেই না। বেশ কয়েক বছর আগে সেখানে এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। তাঁর মা দীর্ঘদিন ঘাতকদের বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিচার পাননি। বিচার পাননি আরও অনেক সন্তানহারা মা–বাবা। 

যে ছাত্ররাজনীতি একের পর এক মায়ের কোল খালি করে কিংবা নবাগত ছাত্রীকে পিটিয়ে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, সেই ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন কী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জবাব দেবেন কি? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com