মতামত

যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সংঘাতে সরু দড়ির ওপর হাঁটছেন এরদোয়ান

গত সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে রাশিয়ার সোচি শহরে একটি রিসোর্টে বৈঠকে বসেন
ছবি : এএফপি

ইউক্রেন যুদ্ধ যতই তীব্র হচ্ছে, তুরস্ক ততই রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসাবে হাজির হচ্ছে। এ ধরনের বিদেশনীতি শুধু কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে নয়, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ ককেশাসেও আঙ্কারার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করছে।

গত সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে রাশিয়ার সোচি শহরে একটি রিসোর্টে বৈঠকে বসেন। এর মাত্র ১৭ দিন আগে তেহরানে দুই নেতার মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছিল। খবরে প্রকাশ, এরদোয়ান সেখানে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনার ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইরানের ‘সবুজ সংকেত’ পেয়েছেন। সোচির আলোচ্যসূচিতেও যুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়া একটি বিষয় হিসাবে ছিল। চার ঘণ্টার বৈঠক শেষে দুই প্রেসিডেন্ট যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি আন্তরিক, অকপট ও  বিশ্বস্ত সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া’ প্রয়োজন। ‘রাজনৈতিক ঐক্য এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার গুরুত্বের ওপরও জোর দেন তাঁরা।

যৌথ এ বিবৃতির মানে কী? তুরস্ক সিরিয়াতে আর হামলা করবে না। তুরস্কের সীমানাসংলগ্ন সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত নিরপেক্ষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে আসবে। সভার আগে ক্রেমলিন সিরিয়াকে ‘অস্থিতিশীল’ না করার আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে সিরিয়ার রাজনৈতিক অখণ্ডতা বিপদগ্রস্ত হয়, সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার কথাও বলে। উত্তর সিরিয়াতে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সিরিয়া প্রধান নিরাপত্তা হুমকি বলে মনে করে। অন্যদিকে রাশিয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে।

এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক এখন কী করতে পারে? সিরিয়াকে সরাসরি অস্থিতিশীল করার পরিবর্তে তুরস্ক এখন অপরোক্ষভাবে ককেশাস অঞ্চলে মস্কোর নামমাত্র মিত্র আর্মেনিয়াকে অস্থিতিশীল করতে পারে। আজারবাইজানের অশান্ত এলাকা নাগোর্ন-কারাবাখকে ঘিরে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান উত্তেজনা সম্প্রতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওই অঞ্চলে দুই হাজারের বেশি রাশিয়ান শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েন রয়েছে।

আজারবাইজানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, আর্মেনিয়াভিত্তিক সেনারা লাচিন জেলায় আজারবাইজানের সেনা অবস্থান লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছে। ওই স্থানটি রাশিয়ার শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এ ঘটনার পর তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ আজারবাইজান পার্বত্য ওই অঞ্চলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আঙ্কারা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রগুলোর একটি। এরপরও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তুরস্ক উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বাধিকার দেখিয়ে যাবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে একটি বাস্তবসম্মত মৈত্রীও বজায় রেখে চলবে। তুরস্কের এই অবস্থানের কারণে অন্তত স্বল্প মেয়াদের জন্য মস্কো ওই অঞ্চলে অনিবার্যভাবেই আঞ্চলিক ক্রীড়নক হিসেবে থাকছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্রেমলিন মধ্যপ্রাচ্য, ককেশাস ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ভূরাজনৈতিকভাবে তুরস্কের অধস্তন অংশীদার হয়ে যাবে।

মস্কো এখন ইউক্রেন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এ অবস্থায় দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চলে কোনো উত্তেজনা ছড়ালে মস্কো কোনো অবস্থাতেই আর্মেনিয়াকে সহযোগিতা করতে পারবে না। অন্যদিকে আজারবাইজানকে খুব শক্তভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে তুরস্ক। ২০২১ সালে তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি জোট গঠিত হয়। নাগোর্ন-কারাবাখের সমাধান না হওয়া উত্তেজনাকে ক্রেমলিনের ওপর চাপ সৃষ্টিতে ব্যবহার করতে পারে আঙ্কারা।

তুরস্কের দিক থেকে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তাতে বেরিয়ে আসবে সিরিয়া ও দক্ষিণ ককেশাসে ক্রেমলিনের অবস্থান কতটা নাজুক। একই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে, দুই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্য মস্কোর জন্য কতটা কঠিন এখন।

প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বে রাশিয়া যখন ক্রমাগত একঘরে হচ্ছে, এরদোয়ানকে ততই পুতিনের ওপর কর্তৃত্ব করতে দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর ‘বন্ধুবেশী শত্রুকে’ বড় ছাড় দিতে বাধ্য হতে পারেন। অন্যদিকে এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সুবিধা আদায়ের উপায় হিসেবে পুতিনকে ব্যবহার করতে পারেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বারবার বলে আসছেন, পুতিন তাঁকে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে একটা সামরিক ড্রোন কারখানা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

যাহোক তুরস্কের বায়কার কোম্পানি (অত্যাধুনিক মনুষ্যবিহীন আকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) রাশিয়াকে বায়রাক্টার ড্রোন সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ইউক্রেন এই ড্রোন রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোচিতে পুতিন-এরদোয়ান বৈঠকে ড্রোন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে বিবৃতিতে জানিয়েছেন। যদিও এর আগে তিনি বলেছিলেন, দুই নেতার মধ্যে সামরিক প্রযুক্তি সহায়তার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

তুরস্ক ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে বায়রাক্টার ড্রোন নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকতেও পারে, আবার না–ও পারে। কিন্তু এরদোয়ান এর মধ্য দিয়ে সম্ভবত ওয়াশিংটনকে একটা বার্তা দিতে চায়। সেটা হলো, উত্তর সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত পিপলস’স ডিফেন্স ইউনিটের সঙ্গে যুদ্ধে বাধা দেওয়া হলে আমরা রাশিয়াকে ড্রোন বিক্রি করব অথবা মস্কোর সঙ্গে যৌথভাবে ড্রোন নির্মাণে কোম্পানি খুলব।

এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে সেটা ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে বিরাট প্রভাব পড়বে। ২০১৯ সালে রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনায় এমনিতেই ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন কোনো উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়া এরদোয়ানের পছন্দ না–ও হতে পারে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জোটগত মৈত্রী এবং মস্কোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক—এ রকম ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চাইতে পারেন এরদোয়ান।

ন্যাটোর অন্য সদস্যদের মতো রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পথে যায়নি আঙ্কারা। আবার রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনাও বন্ধ করেনি। এ ছাড়া রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার নোভাক জানিয়েছেন, পুতিন ও এরদোয়ান বৈঠকে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে রুবলে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে সম্মত হয়েছে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান রস অ্যাটম সম্প্রতি তুরস্কের মেরসিন প্রদেশে ২০০০ কোটি ডলারে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫০০ কোটি ডলার ভর্তুকি দিয়েছে। ২০২৩ সাল নাগাদ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তুরস্কের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ উৎপাদিত হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আঙ্কারা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রগুলোর একটি। এরপরও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তুরস্ক উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বাধিকার দেখিয়ে যাবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে একটি বাস্তবসম্মত মৈত্রীও বজায় রেখে চলবে। তুরস্কের এই অবস্থানের কারণে অন্তত স্বল্প মেয়াদের জন্য মস্কো ওই অঞ্চলে অনিবার্যভাবেই আঞ্চলিক ক্রীড়নক হিসেবে থাকছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্রেমলিন মধ্যপ্রাচ্য, ককেশাস ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ভূরাজনৈতিকভাবে তুরস্কের অধস্তন অংশীদার হয়ে যাবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
নিকোলা মিকোভিচ রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে সার্বীয় বিশ্লেষক