চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাঁড়াশি চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হেলে পড়া ফিলিপাইনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরির জন্য চীন এখন ফিলিপাইনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী আচরণ শুরু করতে পারে।
ছবি : রয়টার্স

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিরাপত্তা ইস্যুতে পক্ষ বাছাইয়ের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ওপর সাঁড়াশি চাপ প্রয়োগ করে চলেছে। কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে পক্ষ বেছে নিয়েছে। আর কিছু দেশ নিজেদের রক্ষার জন্য শক্ত ‘বেড়া’ দিতে ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশ সেটা সফলভাবে করতে পারলেও অন্যরা তা পারছে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বেড়া দেওয়ার’ এই নীতিকে ‘ইনস্যুরেন্স বা বিমা খোঁজার আচরণ’ বলা যায়। এ ধরনের আচরণে তিনটি গুণ থাকে। এক. কোনো পক্ষ গ্রহণ না করা। দুই. পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষকে অনুসরণ, দুই পক্ষের সঙ্গে যৌথ পদক্ষেপ ও বৈচিত্র্যমুখিনতা। তিন. একটু পিছু হটা অবস্থান গ্রহণ।

যাহোক, দেশগুলো তাদের ভৌগোলিক অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ কারণে ‘বেড়া দেওয়ার’ ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। একটি দেশের শাসকদের অভিজাত সম্প্রদায় কোন দিকে ঝুঁকে পড়ে, অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সেটা বড় কারণ। কম্বোডিয়া, লাওস এবং আপাতভাবে মিয়ানমার এরই মধ্যে চীনের পক্ষ বেছে নিয়েছে। সাম্প্রতিককালে চীনের প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখা যাচ্ছে থাইল্যান্ডের। যদিও দেশটি কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। ১৯৭৫ সালে মে মাসে সে সময়কার থাইল্যান্ড সরকার তাদের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনাকে সরিয়ে নিতে বলেছিল। সে সময় থাইল্যান্ডে ২৭ হাজার মার্কিন সেনা ও ৩০০ যুদ্ধবিমান ছিল। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত থাই সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরিকে থাইল্যান্ডের বন্দরে প্রবেশের অনুমতি দেয় তারা।

সিঙ্গাপুর নিরপেক্ষ থাকার দাবি করেছে। সেটা প্রমাণের জন্য তারা চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে এবং যৌথভাবে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালির নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষা স্মারক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক’, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের সিঙ্গাপুরে আমন্ত্রণ জানানো—এসব বিবেচনায় বলা চলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সত্যিকার অর্থেই ঝুঁকে পড়েছে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাঁড়াশি চাপে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও একটা পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি শিক্ষা নিতে পারে, তাহলে দুই পরাশক্তির মধ্যকার সংঘাতে (যেখানে হারানো ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তি নেই) জড়িয়ে পড়া থেকে তারা তাদের দেশগুলোকে দূরে রাখতে পারবে।

প্রকৃতপক্ষে চীন যতই উদ্বেগ প্রকাশ করুক না কেন, সিঙ্গাপুর সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র শিবিরে চলে যাবে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাঁচ দেশের প্রতিরক্ষা আয়োজনে যুক্ত হতে পারে। এই জোটের অন্য দুটি দেশ অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য। অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহিনীকে মালয়েশিয়া তাদের বাটারওয়ার্থ বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিমানগুলো দক্ষিণ চীন সাগরসংলগ্ন এলাকায় চীনে প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর নজরদারি করে। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া তাদের ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমানগুলোকে জ্বালানি নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। এরপরও মালয়েশিয়া এখন পর্যন্ত ‘বেড়া দেওয়ার’ চেষ্টা করে চলেছে।

ইন্দোনেশিয়া এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমানগুলোকে তাদের দেশে অবস্থান করতে দিতে সম্মত হয়নি। কিন্তু ‘বেড়া তৈরির’ ক্ষেত্রে যথাক্রমে সবচেয়ে খারাপ ও সবচেয়ে ভালো মডেল হতে পারে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম।

মার্কোস কিছুটা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ঝুঁকে পড়েছেন

ফিলিপাইনের অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে চীনবিরোধী ও যুক্তরাষ্ট্রপন্থী অবস্থানের কারণে ফার্দিনান্দো মার্কোস জুনিয়র প্রশাসন আগের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের নীতি পরিত্যাগ করেছেন। দুতার্তের নীতি ছিল, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং ওয়াশিংটনকে পাশ কাটিয়ে চলা। কিন্তু মার্কোস দক্ষিণ চীন সাগরে বিশাল যৌথ মহড়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের সামরিক সম্পর্ক জোরালো করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির (ইডিসিএ) ক্ষেত্রও বাড়িয়েছে তারা।

ইডিসিএ চুক্তির আওতায় আগে ফিলিপাইনের পাঁচটি জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রবেশের সুযোগ ছিল, নতুন করে আরও চারটি জায়গায় এখন থেকে প্রবেশ করতে পারবে। নতুন এ জায়গাগুলোর মধ্যে উত্তর লুজানও রয়েছে, যেটি তাইওয়ান থেকে মাত্র ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চীন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে এই জায়গাগুলো যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দাগিরির কাজে এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে সংঘাত শুরুর প্রস্তুতির কাজে ব্যবহার করতে পারে।

বেইজিংয়ের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ম্যানিলা মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু করে। সিনেটে শুনানিতে ফিলিপাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইডিসিএ চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রকে যেসব অঞ্চলে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোয় মার্কিন সেনাদের অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলতে দেওয়া হবে না।’

মার্কোসের অভিব্যক্তি ছিল আরও কাঠখোট্টা। তিনি বলেন, ‘ইডিসিও অঞ্চলের কোনোটিতেই অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর কাজে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তাদের কোনো বিমান, জাহাজ বা অন্য কোনো যান মেরামত কিংবা জ্বালানি ভরার কাজে ব্যবহার করতে পারবে না।’ এর ফলে চীনকে ঠেকানোর জন্য ফিলিপাইনের সঙ্গে করা যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলগুলো চুক্তি নিশ্চিতভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হেলে পড়া ফিলিপাইনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরির জন্য চীন এখন ফিলিপাইনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী আচরণ শুরু করতে পারে। এ ছাড়া চীন ফিলিপাইনের ওপর অর্থনৈতিক প্রতিশোধ নিতে পারে, যেটা মার্কোস প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলবে। তাতে অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনপন্থী ও যুক্তরাষ্ট্রপন্থীদের মধ্যে বিভক্তি বাড়তে পারে। ফলে এমন এক রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্রকে দৃশ্যের বাইরে বের করে দিতে পারে। যেমনটা আগেও ঘটেছে।

ফিলিপাইনের এই দৃষ্টান্ত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলো এখন বোধ হয় ভালো করেই বুঝতে পারছে যে কোনো এক পক্ষে যাওয়ার বিপদ কতটুকু। আর সে কারণেই তারা তাদের চারপাশের ‘বেড়া’ আরও শক্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অচল প্রহেলিকার মধ্যে নিজেদের ফেলতে চায় না কেউ।

পরাশক্তির হাতে নিষ্পেষিত হওয়ার দুঃসহ ইতিহাস রয়েছে ভিয়েতনামের। দেশটির গৃহযুদ্ধ ছিল পরাশক্তিগুলো মতাদর্শিক লড়াইয়ের ফলাফল।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে চলছে ভিয়েতনাম

ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশলনীতি প্রণয়ন ও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের কাছ থেকে অন্যরা শিক্ষা নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পক্ষকে প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ না করে কিংবা কোনো এক পক্ষে হেলে না পড়ে খুব দক্ষতার সঙ্গে ভিয়েতনাম তাদের নিরাপত্তাকৌশল ঠিক করতে পেরেছে। পরাশক্তির হাতে নিষ্পেষিত হওয়ার দুঃসহ ইতিহাস রয়েছে ভিয়েতনামের। দেশটির গৃহযুদ্ধ ছিল পরাশক্তিগুলো মতাদর্শিক লড়াইয়ের ফলাফল।

ভিয়েতনাম কৌশলের দিক থেকে রাশিয়ার মিত্র। চীনের সঙ্গে তাদের সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্বের সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীর সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের রণতরি ভিয়েতনামের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ায় সম্প্রতি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সেই সম্পর্কটাতে চিড় ধরেছে। চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও ভিয়েতনাম তাদের সমুদ্রসীমার দাবি তুলে ধরতে কোনো দ্বিধা করেনি।

এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম চারটি ‘না-এর নীতি’ বজায় রেখে চলেছে। এক. কোনো সামরিক জোটে যুক্ত না হওয়া, দুই. বিদেশি কোনো দেশের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে দেশকে ব্যবহার হতে না দেওয়া, তিন. দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে কোনো একটির পক্ষে না যাওয়া এবং চার. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ কিংবা বলপ্রয়োগের হুমকি না দেওয়া। পরাশক্তির মধ্যকার সামরিক সংঘাতের উত্তাপে জড়িয়ে না পড়তে ভিয়েতনামের এই চার ‘না’ নীতি শক্ত বেড়া হিসেবে কাজ করেছে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাঁড়াশি চাপে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও একটা পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি শিক্ষা নিতে পারে, তাহলে দুই পরাশক্তির মধ্যকার সংঘাতে (যেখানে হারানো ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তি নেই) জড়িয়ে পড়া থেকে তারা তাদের দেশগুলোকে দূরে রাখতে পারবে।

  • মার্ক ভ্যালেন্সিয়া অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো হুয়াইয়াং ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম কো–অপারেশন অ্যান্ড ওশান গভর্ন্যান্স
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে