কেন লেখেন আসলে একজন লেখক?
জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘আমি কেন লিখি’-তে (১৯৪৬) লেখার চারটা কারণ নির্দেশ করেছেন—
১. নিছক আত্মপ্রেম থেকে: আমাকে সবাই চালাক মনে করুক, আমাকে নিয়ে কথা বলাবলি চলুক, আমার মৃত্যুর পরও মানুষ মনে রাখুক—এসব কারণে।
২. নান্দনিক প্রেরণা থেকে: বহির্জগতের সৌন্দর্যের ধারণা দিয়ে তাড়িত হয়ে, যেমন শব্দগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে দেখিই না কী সৌন্দর্য তা তৈরি করে।
৩. ইতিহাসবোধের তাড়না থেকে: মানুষ চায় তার চারপাশটা যেমন আছে, তেমনই থাকুক। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য সত্য অনুসন্ধান করা এবং তা সংরক্ষণ করা।
৪. রাজনৈতিক কারণে: রাজনীতি বলতে যত দূর পর্যন্ত ভাবা যায়, তত দূর অর্থেই রাজনীতি। দুনিয়াটাকে বা সমাজটাকে আমি যে রকমভাবে ভাবি, সে রকমভাবে বদলে ফেলার জন্য অনেকেই লিখে থাকেন।
অধ্যাপক ভ্লাদিমির নবোকভ একটা ক্লাসে ছাত্রদের ১০টা পয়েন্ট দিয়ে ভালো পাঠকের গুণে টিকচিহ্ন দিতে বলেছিলেন।
১. পাঠক একটি বুক ক্লাবের সদস্য হবে।
২. পাঠক বইয়ের নায়ক বা নায়িকার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলবে।
৩. পাঠক সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের ওপরে বেশি জোর দেবে।
৪. পাঠক সেই গল্প পছন্দ করবে, যাতে অনেক ঘটনা আর সংলাপ আছে। ঘটনা-সংলাপহীন কাহিনির চেয়ে ঘটনা-সংলাপওয়ালাটাই তার বেশি পছন্দ।
৫. পাঠক গল্পটি থেকে বানানো চলচ্চিত্র দেখে ফেলেছে।
৬. পাঠক একজন উঠতি লেখক।
৭. পাঠকের কল্পনাশক্তি থাকবে।
৮. পাঠক স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন হবে।
৯. পাঠকের একটি অভিধান থাকবে।
১০. পাঠকের শৈল্পিক গুণ বিচারের ক্ষমতা থাকবে কিছুটা।
ছাত্ররা জোর দিয়েছিল ২,৩ আর ৪-এ—চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা, সামাজিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, ঘটনা ও সংলাপ। আর নবোকভ বলছেন, স্মৃতিশক্তি, কল্পনা, অভিধান আর শৈল্পিক গুণ বিচারের ক্ষমতাই ভালো পাঠকের লক্ষণ।
আর ভালো লেখকের তিনটা গুণের কথা বলছেন নবোকভ—গল্পের কথক, শিক্ষক ও জাদুকর। তিনি জাদুকর শব্দটাতেই জোর দিচ্ছেন। রফিক-উম-মুনীর চৌধুরীর অনুবাদে ‘মারিয়ো বার্গাস ইয়োসার মুখোমুখি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস’ নামে একটা বই আছে। এ সাক্ষাৎকার গত শতকের ষাটের দশকের। ইয়োসা প্রথমেই প্রশ্ন করলেন মার্কেসকে, লেখকের কাজ কি প্রকৌশলী বা স্থপতি বা ডাক্তারের কাজের মতো প্রয়োজনীয় বা তা থেকে আলাদা?
মার্কেস যে উত্তরটা দিয়েছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই বিস্ফোরণমূলক। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, উপন্যাসের ভূমিকা বিধ্বংসী।...আমি কোনো ভালো সাহিত্যের হদিস জানি না, যা প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের গুণগান করে। ভালো সাহিত্যে সব সময়ই প্রতিষ্ঠিত জেঁকে বসা ধ্যানধারণা-মূল্যবোধকে ভেঙে নতুন জীবনযাপনের, নতুন সমাজ গড়ার প্রবণতা থাকে। মোদ্দাকথা, মানুষের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘একজন লেখক সব সময়ই সমাজের সঙ্গে বিবাদ করছেন, আরও বলব, আমার ধারণা একজন লেখক লেখেন তাঁর পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বিরোধের অবসান খোঁজার একটি উপায় হিসেবে।’
আসলেই লেখকের কাজ সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা। তা করার জন্য তিনি একটা কাহিনি ফাঁদেন।
পৃথিবীর সর্বত্র বিচিত্র বই বের হয়—ভালো বই, মন্দ বই, তারকার বই, রান্নার বই, বাগানের বই, জীবন-উন্নয়নের বই। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো দেশে ছাপা বইয়ে ভুল থাকে কি না, এটা নিয়ে গবেষণা করা উচিত। বাংলাদেশেও আমরা চাই আমাদের বইগুলো হোক নির্ভুল, অন্তত মুদ্রণ-প্রমাদবিহীন।
এ বইয়ে মার্কেস আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘কেউ যদি লেখক হতে চায়, তাহলে লেখালেখি ব্যতীত বাকি সব কাজ গৌণ এবং সেগুলো করতে গিয়ে তার লেখালেখির চর্চা বা অনুশীলন বিঘ্নিত হয়।’
আগে লেখক সম্পর্কে যা বলা হতো, তার সঙ্গে আমি একমত নই; বলা হতো যে লেখকের কোনো চাকরির প্রয়োজন নেই আর সেরা লেখক হতে হলে তাকে দুঃখ-কষ্ট-যাতনা ভোগ করতে হবে। আমি মনে করি, লেখক তার ব্যক্তিগত গার্হস্থ্য ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে সে আরও ভালো লিখতে পারে। পাশাপাশি তাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে, তার সন্তানেরা ও স্ত্রী যেন ভালো থাকে, তবেই লেখক ভালো লিখবে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা লেখকের লেখালেখিতে সাহায্য করে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়।
ভালো প্রকাশকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা—
১. প্রকাশকের একটা পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার ঘোষিত নীতি থাকবে। লেখক কীভাবে কোথায় পাণ্ডুলিপি জমা দেবেন এবং কত দিনের ভেতরে লেখককে জানানো হবে, তা প্রকাশিত হবে কি না, এটার নিয়ম থাকবে, আর প্রকাশক তা মানবেন।
২. পাণ্ডুলিপি বাছাইয়ের জন্য তার পরিষদ থাকবে, বিশেষজ্ঞ থাকবে।
৩. পাণ্ডুলিপি প্রাথমিকভাবে বাছাই হলে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা, উন্নত করার জন্য পরামর্শ দেওয়া, ভাষা সংশোধন, তথ্য সংশোধন, ফোকাস নির্দিষ্ট করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটা বড় সম্পাদনা পরিষদ থাকবে।
৪. লেখকের সঙ্গে প্রকাশক চুক্তি করবেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল প্রকাশক ও লেখকের কাছ থেকে আইনগত অনুমতি নিয়ে আসবেন। বছরের শেষে রয়্যালটির হিসাব দেবেন।
৫. প্রকাশকের প্রকাশনার স্টাইলশিট থাকবে। তিনি কীভাবে পৃষ্ঠা সাজাবেন, কীভাবে প্রচ্ছদ করবেন, তা একটা নীতির আওতায় থাকবে।
৬. প্রকাশকের মার্কেটিং বা বই প্রচারের আলাদা দল ও কর্মসূচি থাকবে।
৭. বইটি বিপণনের ব্যবস্থা তার থাকবে। সারা দেশে ও দেশের বাইরে বইটি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ তাঁরা নেবেন।
৮. বই ছাপার কাজগুলো করার জন্য—কম্পোজ, প্রুফ সংশোধন, পৃষ্ঠাসজ্জা, প্রচ্ছদ ডিজাইন, ছাপা, বাঁধাই, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, প্রচার, সরবরাহের জন্য—তাঁর নিয়মিত ব্যবস্থা থাকবে।
বড় ভালো প্রকাশকের তাই নিয়মিত স্টাফের একটা বড় দল থাকার কথা। কম্পোজিটর বা প্রুফ রিডার নয়, রীতিমতো বিশেষজ্ঞর দল। তবে অনেক অলটারনেটিভ প্রকাশকও থাকবেন। যাঁরা হয়তো এক-দুজনের টিম দিয়েই বই বের করেন, কিন্তু তাঁদের বইটাও হবে সুসম্পাদিত, সুপ্রকাশিত, সুমুদ্রিত ও নির্ভুল। আর সারা পৃথিবীতেই সেলফ পাবলিকেশন আছে। নিজের বই নিজে প্রকাশ করায় কোনো ক্ষতি নেই। লজ্জাও নেই।
পৃথিবীর সর্বত্র বিচিত্র বই বের হয়—ভালো বই, মন্দ বই, তারকার বই, রান্নার বই, বাগানের বই, জীবন-উন্নয়নের বই। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো দেশে ছাপা বইয়ে ভুল থাকে কি না, এটা নিয়ে গবেষণা করা উচিত।
বাংলাদেশেও আমরা চাই আমাদের বইগুলো হোক নির্ভুল, অন্তত মুদ্রণ-প্রমাদবিহীন।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক