এটি অবশ্যই রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য ক্ষতিকর হবে।
এটি অবশ্যই রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য ক্ষতিকর হবে।

মতামত

পুতিনবিরোধী রুশরা দেশে থাকবে, নাকি দেশ ছাড়বে?

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ঠিক কতজন রুশ নাগরিক দেশ ছেড়েছেন তা পরিষ্কার নয়। কেউ বলেন দশ লাখের বেশি, কেউ বলেন তার কম। যাঁরা দেশ ছেড়েছেন, তাঁদের মধ্যে মধ্যে রয়েছেন: লেখক, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, অভিনেতা এবং আরও অনেক মেধাবী।

 এমন অনেকে রাশিয়া ছড়ে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন, কারণ যাওয়া ছাড়া তাঁদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না বা নেই। অনেক সাংবাদিক আছেন যাঁরা পুতিনের যুদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন। তেমনই একজন হলেন দ্য নিউ টাইমসের সম্পাদক ইয়েভজেনিয়া আলবাটস। ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানো বা ‘বিদেশি এজেন্ট’ হওয়ার অভিযোগ ঘাড়ে নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া এড়ানোর জন্য তাঁকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।

রাশিয়ার প্রখ্যাত ব্যালে নাচের দল বলশোই ব্যালের প্রধান নৃত্যশিল্পী ওলগা স্মিরনোভা রাশিয়া ছেড়ে আমস্টারডামে চলে এসেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি ‘কখনো ভাবেননি’ তাঁকে কোনোদিন ‘রাশিয়ার জন্য লজ্জিত’ হতে হবে। কিন্তু এই যুদ্ধ তাঁকে শেষ পর্যন্ত নিজ দেশে থাকা অসম্ভব করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি ‘পারশিয়াল মোবিলাইজেশন’ বা ‘আংশিক সংঘবদ্ধকরণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে রুশ নাগরিকদের তরুণ অংশকে যুদ্ধে যোগ দিতে বলেছেন। এই ঘোষণার পরপরই অনেক মেধাবী তরুণ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কারণ তাঁরা মনে করেন, রাশিয়া এমন একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে যা তাঁরা কখনোই চান না।

থেকে যাওয়া এবং ছেড়ে যাওয়া—এই দুটির একটিকে বেছে নেওয়ার বিষয়টি সব দিক থেকে অনেক বেশি স্ব-ধার্মিকতাকে উসকে দেয়। যারা নিরাপদে দেশের বাইরে আছেন এবং যুদ্ধ ও স্বৈরাচারের বর্বরতা থেকে নিরাপদ আছেন, তাঁরা প্রায়শই জোর দিয়ে বলেন, যাঁরা দেশে থাকছেন তাঁদের অবশ্যই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।

মস্কোতে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, যাঁরা চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ও চলে গেছেন তাঁদের সংখ্যা রাশিয়ায় থাকতে চাওয়াদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা পুতিনের যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন এখনো রাশিয়া ছেড়ে যেতে পারছেন না। তাঁদের মধ্যে কেউ আছেন যিনি তাঁর পরিবারকে ফেলে যেতে চান না; কেউ আছেন যিনি রাশিয়ার বাইরে অন্য কোথাও নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়ার উপায় দেখছেন না; কেউ আছেন যিনি নিজ দেশে যা ঘটছে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে চান।  

এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিকে বেছে নেওয়া সহজ ব্যাপার না। নাৎসি জার্মানি কিংবা কমিউনিস্ট চীনের আমলের মতো অন্যান্য দেশে অন্যান্য সময়ে সেখানকার মানুষকে ‘দেশ ছাড়ব নাকি দেশে থাকব’—এমন ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মুখে পড়তে হয়েছে। এই সব পরিস্থিতিতে আপনি যদি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যান তাহলে আপনি আপনার নিজের দেশে অপ্রাসঙ্গিক ও বিদেশে অবাঞ্ছিত অতিথি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। আবার আপনি যদি থেকে যান, তাহলে আপনাকে কারাগারে যেতে হতে অথবা তার চেয়ে খারাপ পরিণতির মুখে পড়তে হতে পারে।

যাঁরা দেশত্যাগ করেন তাঁদের প্রায়শই দেশবাসীর কাছে কাপুরুষ বা বিশ্বাসঘাতক হিসাবে সমালোচিত হতে হয়; আবার যাঁরা ভিন্নমতাবলম্বীরা হিসেবে থেকে যান, তাঁদের বিদেশি শক্তি ও নিজ দেশের সরকারের মাঝখানে পড়ে কঠিন চাপ সহ্য করতে হয়।
যে রাশিয়ানরা নিজের দেশকে ভালোবাসেন কিন্তু যুদ্ধকে ঘৃণা করেন তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সেই জার্মানদের দশায় পড়েছেন যাঁরা জার্মানিকে ভালোবাসতেন কিন্তু নাৎসিদের ঘৃণা করতেন। এই অবস্থায় পড়া লোকদের খুব কমই বন্ধু থাকে।

থেকে যাওয়া এবং ছেড়ে যাওয়া—এই দুটির একটিকে বেছে নেওয়ার বিষয়টি সব দিক থেকে অনেক বেশি স্ব-ধার্মিকতাকে উসকে দেয়। যারা নিরাপদে দেশের বাইরে আছেন এবং যুদ্ধ ও স্বৈরাচারের বর্বরতা থেকে নিরাপদ আছেন, তাঁরা প্রায়শই জোর দিয়ে বলেন, যাঁরা দেশে থাকছেন তাঁদের অবশ্যই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।

রাশিয়ার সর্বোত্তম এবং উজ্জ্বলতম প্রতিভাধরদের পশ্চিমে গণহারে চলে যাওয়া পশ্চিমের বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি আশীর্বাদ হয় বসতে পারে। এবং এটি অবশ্যই রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য ক্ষতিকর হবে। তবে পুতিন তাঁর ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্নে এসবকে পাত্তা দেবেন না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল বইয়ের লেখক