রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আর কত দেরি

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা উপন্যাস সুলতানা’স ড্রিম জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘বিশ্বস্মৃতি’ বা ‘ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় স্থান পেয়েছে।

এই বছরের মে মাসে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাটোরে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কমিটি ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক বা মৌক্যাপের দশম সাধারণ সভায় ঘোষণাটি দেওয়া হয়।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই খবরে খুব আনন্দিত হলাম। একই সঙ্গে মনে পড়ল ২০১৯-এর একটি অভিজ্ঞতা। তখন আমি পেশাগত কারণে লন্ডনে। নারী দিবসে অফিসে এক অনুষ্ঠান। কয়েকজন সহকর্মী যেসব নারী দ্বারা জীবনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাঁদের কথা বলেছিলেন। তাঁরা শিল্পী ফ্রিদা কাহলো থেকে শুধু করে কিশোরী জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ পর্যন্ত অনেককে নিয়েই বক্তব্য দিলেন।

আমি বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম নিয়ে বললাম। এরপর কয়েকজন তাঁকে নিয়ে আরও জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ, নারী জাগরণের এই অগ্রদূতের নাম তাঁরা আগে কখনো শোনেননি।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মৌক্যাপের কাছে সুলতানা’স ড্রিম নিয়ে আবেদন জানিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আশা করি এই স্বীকৃতিতে বেগম রোকেয়ার অবদান নিয়ে বহির্বিশ্বের মানুষ আরও জানবেন। পাশাপাশি শুধু রোকেয়া দিবসের বাইরে গিয়ে তাঁর কাজ নিয়ে আমাদের চর্চা করা প্রয়োজন।

শত বছর আগে লেখা সুলতানা’স ড্রিম এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। এই গল্পে শুধু নারীর ক্ষমতায়ন নয়, পরিবেশ রক্ষা নিয়ে বেগম রোকেয়ার ভাবনা আমদের বিস্মিত করে। একজন নারীবাদী চিন্তাবিদ, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক হিসেবে বেগম রোকেয়া আজও আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। এখনো বাল্যবিবাহ নিরসনে তাঁর লেখা (যেমন ‘কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন?’) প্রাসঙ্গিক। সমাজে নারীকে অধস্তন করে রাখার ক্ষেত্রে ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে রোকেয়ার ক্ষুরধার বিশ্লেষণ, পর্দাপ্রথা এবং নানা সামাজিক আচার নিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ শ্লেষ আজকের মানদণ্ডেও অত্যন্ত সাহসী।

১৯১১ সালে কলকাতায় মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রথম বিদ্যালয়টি (সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন বেগম রোকেয়া। তিনি মেয়েদের খেলাধুলায় বিশেষ জোর দিতেন। এ থেকেও বোঝা যায়, চিন্তার দিক থেকে তিনি কতটা অগ্রসর ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি রোকেয়া হলে স্থাপিত বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্যের দিকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাকাতাম। তাঁকে মুসলিম নারীশিক্ষার পথিকৃৎ হিসেবে ভাবতেই আমরা অভ্যস্ত। তবে তাঁর সংগ্রামটাকে বোধ হয় আমরা এখনো সঠিকভাবে ধরতে পারিনি, পরিপূর্ণ মূল্যায়ন হয়নি তাঁর কাজের।

চার দেয়ালে বন্দী গার্হস্থ্য জীবনের বাইরে একজন ব্যক্তি হিসেবে নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদা আছে, এ বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন। পদ্মরাগ উপন্যাসের সিদ্দিকার ভাষায়, ‘আমরা কি মাটির পুতুল যে পুরুষ যখন ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করিবেন, আবার যখন ইচ্ছা গ্রহণ করিবেন?...আমি যদি উপেক্ষা লাঞ্ছনার কথা ভুলিয়া গিয়া সংসারের নিকট ধরা দিই, তাহা হইলে ভবিষ্যতে এই আদর্শ দেখাইয়া দিদিমা ঠাকুমাগণ উদীয়মানা তেজস্বিনী রমণীদের বলিবেন, “আর রাখ তোমার পণ ও তেজ-ঐ দেখ না এতখানি বিড়ম্বনার পর জয়নব (সিদ্দিকা) আবার স্বামীসেবাই জীবনের সার করিয়াছিল।” আর পুরুষ সমাজ সগর্বে বলিবেন, “নারী যতই উচ্চশিক্ষিতা, উন্নতমনা, তেজস্বিনী, মহীয়সী, গরীয়সী হউক না কেন, ঘুরিয়া ঘুরিয়া আবার আমাদের পদতলে পড়িবেই পড়িবে।”

আমি সমাজকে দেখাইতে চাই, একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারীজন্মের চরম লক্ষ্য নহে; সংসারধর্মই জীবনের সারমর্ম নহে।’ সিদ্দিকা জীবনের অর্থ খুঁজে পান নারী জাগরণের জন্য কাজ করে। বেগম রোকেয়া যে কতটা বৈপ্লবিক, তা বোঝার জন্য ১৯২৪ সালে সৃষ্ট এই একটি চরিত্রই যথেষ্ট।

নারীদের শিক্ষা ও কর্মজগতে অংশগ্রহণে বেগম রোকেয়ার সময়ের তুলনায় আমরা অনেক এগিয়েছি। তবে সমান ‘মানুষ’ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার স্বপ্ন—যে কথা তিনি বারবার বলেছেন—এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তিবিষয়ক আইনের চোখে বাংলাদেশের নারীরা আজও সমান নন। মা-বাবা যখন ছেলে ও মেয়েসন্তানকে আলাদাভাবে দেখেন, তাঁদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যাশা করেন, তখন পরিবার থেকেই বৈষম্যের শুরু হয়। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।

সম্প্রতি বাগেরহাট, কুড়িগ্রাম ও ঢাকায় ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে চারটি কর্মশালা সঞ্চালনা করার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে বারবার সামাজিক রীতিনীতির কথা বলা হচ্ছিল। এ কারণেই নাকি নারীরা তাঁদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজে অবদান রাখতে পারছেন না। যেসব নারী পড়াশোনা শেষ করতে পারেন, তাঁরাও পেশাগত জীবনে সফল হওয়ার পথে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হন। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক মনোভাব ও আচরণ এবং ঘরের কাজের দায়িত্বজনিত অতিরিক্ত চাপ তাঁদের জীবনে সাফল্য অর্জনে বিরাট অন্তরায়।

ধরা যাক, বেগম রোকেয়া ২০২৪ সালের বাংলাদেশ পরিভ্রমণে এসেছেন। বিশ্বের যে ১০টি দেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ এ তালিকায়—এই তথ্যে তিনি কতটা কষ্ট পেতেন? ভয়াবহ নারী নির্যাতনের খবরে তিনি কতটা বিচলিত হতেন?

এখনো অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ে ও সন্তান পালনকে নারীজীবনের সার্থকতা মনে করা হয় এবং নারীরা তাঁদের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছেন না দেখলে বেগম রোকেয়ার প্রতিক্রিয়া কেমন হতো? গণমাধ্যমে নারীদের দুর্বল, পরনির্ভরশীল, শুধু সৌন্দর্যচর্চায় আগ্রহী হিসেবে যে গৎবাঁধা উপস্থাপন, সেসব দেখেই-বা তিনি কী ভাবতেন? নারী অধিকার নিয়ে আমাদের অর্জন বিষয়ে আত্মতৃপ্তি প্রকাশের আগে এই প্রশ্নগুলো করা জরুরি।

নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি সংস্কার এবং বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন, সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত সনাতন ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা, ছেলে ও মেয়েসন্তানকে সমানভাবে দেখা এবং নারীদের শিক্ষা ও পেশাগত সাফল্যের উদ্‌যাপন। সবচেয়ে বড় বিষয়, নারীকে ‘সমান’ মানুষের মর্যাদা দিতে শেখা।

বেগম রোকেয়া যে সমানাধিকার ও নারীমুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন, তা বাস্তবায়নে আর কত দেরি?

● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী