রাত নয়টার দিকে হাতিরপুল থেকে রিকশায় উঠলাম। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। গুলিস্তানের নর্থ সাউথ রোডের সিদ্দিকবাজারে স্যানিটারি মার্কেটে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতদের সেখানেই আনা হচ্ছে। একের পর এক বিস্ফোরণে ঘটনা। কী ঘটছে আসলে দেশটাতে!
রাস্তায় শবে বরাতের আমেজ। মসজিদের সামনে মুসল্লিদের ভিড়। রাস্তা কিছুটা ফাঁকাই ছিল। সাধারণত বড় কোনো ঘটনা ঘটলে সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাই। রিকশাচালক, চা বিক্রেতা বা হকার—তাঁরা ঘটনা শুনেছেন কি না বা এ নিয়ে তাঁদের কী মনোভাব, তা বোঝার চেষ্টা করি।
গত রাতে রিকশায় উঠে চালকের কাছে কিছু জানতে চাওয়ার আগে তিনি নিজ থেকেই কথা বলে উঠলেন, ‘মামা, আলুবাজারের কথা কিছু শুনছেন?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘গুলিস্তানের বিস্ফোরণের কথা বলছেন?’ এরপর উনি বলতে থাকেন, ‘জি মামা, আমি ওই সময় ওখানে ছিলাম। মান্ডা থেকে একটা খেপ নিয়ে গেছিলাম। রাস্তার আরেক পারে ছিলাম। মনে হইল বিশাল বোমা ফুটছে। কলিজা কেঁপে উঠছিল। এখনো মনে হইতেছে ঠিকমতো কানের আওয়াজ পাইতেছি না। তারপর কেমনে যে ওই এলাকা ছাড়ছি!’
রিকশাচালকের নাম মোহাম্মদ মিঠুন। বাড়ি রংপুর। বেশ হাসিখুশি মনে হলো। সেটি তাঁকে বলাতেই তার উত্তর ছিল এমন, ‘মামা, পরিশ্রম করে খাই। কোনো ঝামেলায় নাই।’ আমিও তাঁর কথা সায় দিলাম। দশ কি পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি জরুরি বিভাগের সামনে নামিয়ে দিলেন। ভাড়া মিটিয়ে চলে যাওয়ার সময় মিঠুন বললেন, ‘মামা, দোয়া কইরেন।’ আমি পেছন ফিরে একটি হাসি দিলাম। তবে সামনে এগোতেই দেখলাম কান্নার দৃশ্য।
রাস্তায় জরুরি বিভাগের মূল ফটকের সামনে এক তরুণ আরেক তরুণকে ধরে কান্না করছেন। সাদা পাঞ্জাবি পরা বন্ধু হাউহাউ করে বলছেন, ‘ও বন্ধু, ও বন্ধু।’ তিনি একটু শান্ত হওয়ার পর দুজনের সঙ্গে কথা বললাম। একজনের নাম সালাউদ্দিন, আরেকজন মো. আনোয়ার। বিস্ফোরণে এক বন্ধুকে হারিয়েছেন তাঁরা। বন্ধুর নাম মোহাম্মদ হৃদয়। ওই মার্কেটের সামনে পান–সিগারেট নিয়ে বসতেন হৃদয়ের বাবা। তো সেখানে ছেলেকে বসিয়ে কী কাজে বাসায় গিয়েছিলেন তিনি। ফিরে এসে পেলেন ছেলের রক্তাক্ত লাশ। এ বাবা সারাজীবন নিজেকে কীভাবে স্বান্তনা দেবেন!
জরুরি বিভাগের দিকে যত এগোতে থাকি তত মানুষের ভিড়। বেশির ভাগ মানুষের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। বিস্ফোরণে হতাহতরা বেশির ভাগই পুরান ঢাকার মানুষ বা সেখানে থাকেন। পুরান ঢাকায় শবে বরাত মানে এক ঐতিহ্যময় উদ্যাপন। পোশাকে সেই উদ্যাপনেরই ছাপ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভাগ্য নির্ধারণের মহিমান্বিত এই রাতে তাঁদের ছুটে আসতে হয়েছে হাসপাতালের মর্গে।
চারদিকে নিরাপত্তা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী দল, সংবাদকর্মী, প্রশাসনের মানুষ। কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢুকলেই স্বজনেরা সেদিকে ছুটে যাচ্ছেন। নিত্যদিনের রোগীর চাপও আছে, কিছুক্ষণ পরপর অ্যাম্বুলেন্স আসতেই থাকে। নিরাপত্তাকর্মীরা সামনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন, ফটকের সামনে থেকে মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছেন।
ভেতরের ফটকের কোনায় কয়েকজন তরুণ–তরুণী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন বন্ধুর বাবার লাশের জন্য। এখনো হাসপাতালে আনা হয়নি। নাম–পরিচয় জানতে চাইলে তরুণী বললেন, ‘আপনি কি এগুলো পত্রিকায় লিখবেন?’ শুধু বললেন, বন্ধুর বাবার স্যানিটারির দোকান ছিল মার্কেটটিতে।
এরপর কয়েকজন সংবাদকর্মী বন্ধুর সঙ্গে বের হয়ে রাস্তায় এলাম। তাঁরা বিকেল থেকে এখানে। কিছু খেতে চান। তখন দেখলাম ভ্যানগাড়িতে একটি খাটিয়া করে একটি মৃতদেহ নিয়ে কয়েকজন মানুষ দৌড়ে আসছেন। জরুরি বিভাগের ফটক দিয়েই ঢুকছেন তাঁরা। পেছন পেছন গিয়ে একজনের সঙ্গে কথা বললাম। সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণেরই আরেক শিকার। স্বজনেরা ঘটনাস্থলের পাশেই আলুবাজার এলাকায় বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন আনুষ্ঠানিকতা সারতে আর কাগজপত্র সংগ্রহ করতে। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ ইসমাইল। তিন ছেলের বাবা। বড় ছেলের বয়স বারো বছর হবে। বাকি জমজ বাচ্চার এখনো ছোটো।
এভাবে আরও আরও নিহতের দেখা পেলাম। রাত প্রায় একটা বাজে। মর্গের প্রক্রিয়া শেষে একের পর এক লাশ বের হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। কেউ কাগজপত্র নিয়ে জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রের সামনে যাচ্ছেন। নিহতের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা, গুরুতর আহতের জন্য পঁচিশ হাজার টাকা, অল্প আহতের জন্য পনের হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন কয়েকজন। তাদের দুইজন স্বজন নিহত হয়েছেন। স্বামী–স্ত্রী। স্যানিটারি মার্কেটে জিনিসপত্র কিনতে গিয়েছিলেন। মৃত্যুই যেন সেখানে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের। স্বজনের হাতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজী হাফিজুল আমিন পঞ্চাশ হাজার টাকার দুইটি বান্ডিল তুলে দিয়ে বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে।
সেখানে আরেকজন নিহতের লাশ নিয়ে হাজির স্বজনেরা। একজন মোবাইল থেকে বের করে ছবি দেখালেন, বয়স্ক লোক। তিনিও মার্কেটেরই ব্যবসায়ী। কয়েকজন মিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। সেখানেই ঘটে গেল তাঁর জীবনের ইতি। তথ্য কেন্দ্রে দুইজন নিখোঁজের আবেদন পড়েছে। একটু পরপরই নিখোঁজদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল কী না, এসে জিজ্ঞাসা করছেন স্বজনেরা এসে।
বের হওয়ার আগে ভাবলাম, শেষবারের মতো মর্গের সামনে থেকে ঘুরে আসি। যতই ভেতরে যাই মেঝেতে রক্তের দাগ। ফোটা ফোটা রক্তের চিকন সারি। সেখানেই পেলাম আরেক নিহতের স্বজন ইসহাক আহমেদকে। তিনিও ব্যবসায়ী। তাঁর ভাতিজির স্বামী বাবুল ইসলাম। ওই মার্কেটে স্যানিটারি পণ্য সরবরাহ করতেন। ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়েছিলেন টাকা তুলে আনতে। এক দোকানদার তাঁকে দোকানে বসিয়ে রেখে ওপরের তলায় গিয়েছিলেন বাথরুমে। এতেই বেঁচে গেলেন দোকানদার। আর দোকানসহ পুরো মেঝে নিচের দিকে ধসে পড়ে মারা গেলেন বাবুল।
জরুরি বিভাগ থেকে বের হলাম রাত একটার পর। বিস্ফোরণের নিহত ব্যক্তিরা একে একে ঘরে ফিরছে। এমন ফেরা কি কখনো ভেবেছিলেন তাঁরা, তাঁদের প্রিয়তমা স্ত্রী ও আদরের সন্তানেরা। লাশ নিয়ে মানুষের কান্না, উদ্বেগ দৌড়াদৌড়ি কত কিছু দেখা হলো কয়েক ঘন্টায়। ভাবছিলাম, আমাদের এত উন্নতি হচ্ছে, এত উন্নয়ন ঘটছে কিন্তু শহরগুলো কেন মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। মনটা স্বাভাবিকভাবেই ভার হয়ে আছে। চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। মানুষজন বিশেষত অল্পবয়সী ছেলেরা, তরুণেরা, বন্ধুরা দলবেধে ঘুরছে। মোটরসাইকেলে, রিকসায়, ভ্যানে। সবার পরনে পাঞ্জাবি। বেশির ভাগই সাদা। শহীদ মিনারের সামনে রীতিমতো মেলা বসছে এত রাতে। তিন তরুণের মধ্যে দেখলাম কী বিষয়ে মনমালিণ্য হয়েছে। শুনে বুঝলাম, কোনদিকে ঘুরতে যাবে এ নিয়ে মতের অমিল হয়েছে। হৃদয়, সালাউদ্দিন, আনোয়ার—তিন বন্ধুর কথা মনে পড়ল। তাঁরাও হয়তো পাঞ্জাবী পরে আজকের রাতটিতে এভাবে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু এবার সেটি হলো না, এক বন্ধুর লাশ নিয়ে ঘরে ফিরছে বাকি দুইজন।
কার্জন হলের দিকে যেতে গণিত ভবনের সামনে দিয়ে তখন একটি মিনিট্রাক দাঁড়াল। দুইজন তরুণ নেমে রাস্তার উলটো পাশে ছুটে গেল। কাহিনি কি? খেয়াল করলাম ফুটপাতে শুয়ে থাকা কয়েকজনকে খাবার দিচ্ছেন তারা। তারপর ট্রাকের দিকে তাকালাম, ভেতরে অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট। ট্রাকে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কয়েকজন তরুণ৷ তাদের সাথে কথা বললাম। সবাই বন্ধু। সবার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। প্রতি শবে বরাতে এভাবে ট্রাক নিয়ে বের হন তারা। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ছিন্নমূল মানুষদের খাবার বিতরণ করেন।
সূত্রাপুর থানার সামনের এলাকাতেই তাদের বসবাস। জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো সংগঠন আছে কী না। তারা বলল, এরকম কিছুই নাই। বন্ধুরা মিলে নিজেরা নিজেরাই এ কাজটা করেন। কথা বলে বলে জানলাম, এলাকার কারও কাছ থেকেও চাঁদা নেন না তাঁরা। তাঁদের কেউ পড়ালেখা করেন, কেউ চাকরি করেন। এবার ৬০০ প্যাকেট খাবার করছেন। সবজি খিচুড়ি। গতবার মুরগি খিচুড়ি করেছিলেন৷ এখন মুরগির যে দাম, ফলে এবার সবজি খিচুড়ি কেন সেটি আর জিজ্ঞাসা করলাম না।
অনুমতি নিয়ে ছবি তুললাম। কথা বলতে বলতে দুই একজন রিকশাওয়ালা এসে হাত বাঁড়িয়ে দিল। তরুণেরাও খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিল। এরপর টান দিয়ে চলে গেল গাড়িটা, সফেদ তরুণেরা।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী