ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, রাশিয়ান আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে ‘কাপুরুষোচিত’ সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা মিত্ররা
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, রাশিয়ান আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে ‘কাপুরুষোচিত’ সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা মিত্ররা

মতামত

মাখোঁ কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চান

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বিতর্ক তৈরিতে একেবারে নতুন কেউ নন। এটাকে তিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণ বলেই মনে করতে পারেন। গত মাসে প্যারিসে ইউরোপের ২০টি দেশের সরকারপ্রধানদের সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে মাখোঁ ঘোষণা দেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য পশ্চিমা সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর সম্ভাবনাকে তিনি নাকচ করছেন না। মাখোঁর নেতৃত্বের যে মান, সেই বিবেচনাতেও তাঁর এই ঘোষণাকে বলা চলে বোমা ফাটানোর ঘটনা।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দুই বছর পেরিয়েছে। রাশিয়ার দখলে নেওয়া সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে ইউক্রেনের প্রচেষ্টা স্থবির হয়ে পড়েছে। যদিও ২০২২ সালে আগ্রাসন চালিয়ে রাশিয়া যে ভূখণ্ড দখলে নিয়েছিল, তার অর্ধেকটা আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইউক্রেন। যাহোক, সব মিলিয়ে ইউক্রেনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড এখন রাশিয়ার দখলে। আর রুশ সেনাদের প্রতিরক্ষা ভাঙা এখন আগের চেয়ে বেশি কঠিন।

যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিতে পশ্চিমারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্লান্তি এখন জাঁকিয়ে বসেছে। তবে এখন ভিন্ন কারণে এই সংকট আমাদের মনোযোগের কারণ হয়ে উঠেছে। এই সংঘাত যত দীর্ঘ হচ্ছে, ইউক্রেনের ন্যায়যুদ্ধ ও দেশটির জনগণের বীরত্বের প্রতি সহায়তা ততই মন্থর হয়ে আসছে। বিশেষ করে গত বসন্তে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর সেটা তীব্র হয়েছে।

যুদ্ধ তৃতীয় বছরে পড়ার প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে ইউক্রেনের সফলতা ও ব্যর্থতা মাপার জন্য এই মাপকাঠি ব্যবহার করা হবে খুবই সংকীর্ণ একটা ব্যাপার। প্রথম ও সর্বপ্রথম কথা হচ্ছে, শক্তিশালী প্রতিবেশীর নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যে প্রতিরোধ যুদ্ধ করছে, তাতে সমর্থন দেওয়াটা নৈতিক কর্তব্য।

কিন্তু ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই দাতব্য কাজ নয়। বরং এটি নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা সচল রাখার সামষ্টিক প্রচেষ্টা। এই সমর্থন না দিলে শুধু রাশিয়া নয়, অন্য যেকোনো দেশও আরেকটি দেশের ওপর খোলাখুলি আগ্রাসন চালানোর আশকারা পাবে।

ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে মাখোঁর বক্তব্যের সঙ্গে ইউরোপীয় নেতারা ভিন্নমত করেছেন। এই ইস্যুতে তাঁদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায়নি। এ বিষয়টি অবশ্যই জোটটির জন্য সতর্ক বার্তা। কেননা, এক সপ্তাহ পরেই মাখোঁ তাঁর পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি নির্দয়ভাবে কথার চাবুক চালান।

তিনি বলেন, রাশিয়ান আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে ‘কাপুরুষোচিত’ সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা মিত্ররা। মাখোঁ আরও বলেন, গত সপ্তাহে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এর অর্থ মাখোঁ মুখ ফসকে মন্তব্য করেননি।

ইউক্রেন যুদ্ধে বিজয়ের কৌশল কী হবে—তা নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পশ্চিমা মিত্রদের থেকে ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছেন। তাঁর দাবি, রাশিয়ার অবস্থানে একটা পরিবর্তন এসেছে। দেশটি এখন আরও ভূখণ্ড দখলে নিতে চায়। তাদের চোখ শুধু ইউক্রেনে নয়, অন্য আরও অনেক দেশের ভূখণ্ডের ওপরও পড়েছে। মাখোঁ তাঁর প্রস্তাবকে প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ বলেছেন। অন্য দেশগুলোকেও একই পরামর্শ মেনে চলার যুক্তি দিয়েছেন।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ফিরে যাওয়া যাক। ন্যাটো সদর দপ্তরগুলো তখন স্বস্তির বড় নিশ্বাস ফেলেছিল। কেননা, তারা  এই ভেবে যে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যদেশ নয়। তাদের স্বস্তির কারণ ছিল, ইউক্রেন সদস্যদেশ না হওয়ায় ন্যাটোর আর্টিকেল-৫ চালু করার বাধ্যবাধকতা থেকে তারা বেঁচে গেছেন।

ন্যাটোর আর্টিকেল-৫ অনুযায়ী, যেকোনো সদস্যদেশ তৃতীয় কোনো দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে প্রতিরোধ করা। যাহোক, সে সময়ে ন্যাটো ইউক্রেনের জন্য বড় আকারের সহায়তা দেওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এই সমর্থন ভলোদিমির জেলেনস্কি, তাঁর সরকার ও দেশটির জনগণ ও সেনাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেকখানি সহায়তা করেছে। এর অর্থ হলো পশ্চিমা সেনাদের উপস্থিতি ছাড়াই রাশিয়াকে বাগে রাখার সামর্থ্য ইউক্রেনের রয়েছে।

মাখোঁর এই মরিয়া বক্তব্যের পেছনে নিশ্চিতভাবে কিছু নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের গোলাবারুদ কমে যাওয়া এবং মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য সহযোগিতা তহবিল স্থগিত থাকার মতো ঘটনা রয়েছে। এরপর নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উদ্দেশ্য থেকেও মাখোঁ এটা করতে পারেন।

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, লাটভিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ আরও কয়েকটি দেশ ইউক্রেনে অল্প কিছুসংখ্যক তাদের বিশেষ বাহিনীর সদস্য পাঠিয়েছে। ইউক্রেনের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধ করতে তাদের দেশের নাগরিকদের যাঁরা যেতে চেয়েছেন, তাঁদের তারা আটকায়নি। যাহোক, মাখোঁ এখন যে সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলছেন, সেটার মানে হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তার ঝুঁকি হবে মারাত্মক। এই ঝুঁকিকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। বৈশ্বিক সমর্থন ইউক্রেনের দরকার, সেটা তারা পাওয়ার যোগ্যও। ইউক্রেনের যুক্তিটাও যৌক্তিক।

ইউক্রেনীয়রা বলছেন, এই যুদ্ধটা শুধু তাঁদের একার যুদ্ধ নয়, নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাশিয়া যে হুমকি তৈরি করেছে তার প্রতিরোধ যুদ্ধ।  যাহোক, ইউক্রেনে পশ্চিমা সেনা পাঠানো হবে এ ক্ষেত্রে শেষ পদক্ষেপ। যদি ইউক্রেনের আসন্ন পতনের বিপদ দেখা দেয়, তাহলেই এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ইউক্রেনে ন্যাটো সেনা পাঠানোর ধারণাটির গুরুত্ব আছে। কিন্তু বিশ্ব এখন দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনে পশ্চিমা সেনা পাঠানো হলে বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।

  • ইয়োসি মেকেলবার্গ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদির থিঙ্কট্যাংক চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকা কর্মসূচির সহযোগী ফেলো
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত