মতামত

পানি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কি অবশ্যম্ভাবী

সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারত–পাকিস্তানের উত্তেজনা বাড়ছে
ছবি: রয়টার্স

ছয় দশকের বেশি সময় আগে বিশ্বের সবচেয়ে উদার পানিবণ্টন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সিন্ধু পানি চুক্তির (ইন্দুজ ওয়াটার ট্রিটি, সংক্ষেপে আইডব্লিউটি) শর্ত অনুযায়ী, উজানে থাকা ভারত ভাটিতে থাকা পাকিস্তানকে হিস্যা হিসেবে উপমহাদেশের সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি বড় নদীর সিংহভাগ পানি দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের নিজস্ব পানি সুরক্ষাব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করতে পাকিস্তানের লাগাতারভাবে সেই চুক্তিকে ব্যবহার করার চেষ্টা ভারতকে তার উদার দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।

গত মাসে ভারত পাকিস্তানকে আইডব্লিউটির নতুন শর্ত নিয়ে আলোচনায় বসতে চায় বলে নোটিশ পাঠিয়েছে। চুক্তিটির বিদ্যমান শর্তগুলো বিশ্বব্যাংককে ভারত-পাকিস্তানের যেকোনো মতবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কিংবা হেগের আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে পাঠানোর সুপারিশ করতে অনুমোদন দেয়। কিন্তু ভারতের দাবি, ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারিগরি দিকগুলোর বিষয়ে আপত্তি তুলে সেখানে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার আবেদন জানানোর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান প্রকারান্তরে আইডব্লিউটির বিরোধ নিষ্পন্নসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর অপব্যবহার, এমনকি সেগুলো লঙ্ঘন করছে।

জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের কিষেনগঙ্গা এবং র‍্যাটল হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টের বিষয়ে পাকিস্তান আপত্তি তোলার পর সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক একই সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি ও একটি সালিসি আদালত নিয়োগ করায় এবং আলাদাভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করায় ভারতের অসন্তোষ বেড়ে গেছে। ভারত দাবি করছে, পাকিস্তানকে তারা নোটিশ জারি করার মাত্র দুই দিন পরই সালিসি আদালতের যে কার্যক্রম শুরু হয়, তা আইডব্লিউটির শর্ত লঙ্ঘন করেছে এবং সে কারণে ভারত সেসব কার্যক্রমকে বর্জন করছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক তার দিক থেকে স্বীকার করেছে, দুটি প্রক্রিয়া যুগপৎভাবে চালানোটা ব্যবহারিক ও আইনি দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

আইডব্লিউটির অধীনে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার বিষয়টি সামনে এনে ভারত যে পুনঃ আলোচনার নোটিশ দিয়েছে, সেটি যে সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহেরই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া, তা প্রায় নিশ্চিত। তবে ভারত ভালো করেই জানে, পাকিস্তান এই পুনঃ আলোচনায় রাজি হবে না। এতে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি ভারতের সাম্প্রতিক এই নোটিশ জারি বড় ধরনের বাদানুবাদ ও সংঘাতের শুরু মাত্র। দ্বিতীয় ধাপে হয়তো ভারত সীমান্ত সন্ত্রাসে দীর্ঘকাল ধরে মদদ দেওয়া হাতকে রুখে দেওয়ার কার্যক্রম পদক্ষেপ নেবে।

যখনই জম্মু ও কাশ্মীরের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্য সিন্ধু চুক্তি মেনেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই পাকিস্তান সেটিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সব ধরনের কাজ করেছে। এখন জাতিসংঘ এ বিষয়ে নাক গলানোয় নতুন করে সংকট তৈরি হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে।

ছয় বছর আগে জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘রক্ত আর পানি একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না।’ ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে এবং উপমহাদেশে রক্তপাত এড়াতে যে আইডব্লিউটিতে স্বাক্ষর করেছিল, এক অর্থে মোদির এই কথা সেই চুক্তির মর্মমূলে বিঁধেছিল।

১৯৬০ সালে যখন আইডব্লিউটি স্বাক্ষরিত হয়, তখন চীন-ভারত উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। সে কারণে ভারত তার অপর বড় প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তির প্রশ্নে পানির বিনিময়ে চুক্তি করেছিল। আইডব্লিউটি চুক্তি ধরে ভারত অববাহিকার পানির ২০ শতাংশের কম নিজের ভাগে রাখতে রাজি হয়।

বিশ্বের কোথাও উজানে থাকা কোনো দেশ ভাটির দেশকে এই পরিমাণ ছাড় দিয়েছে বলে নজির নেই। কিন্তু এই চুক্তি ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে (যার ওপর দিয়ে সিন্ধু অববাহিকার তিনটি নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে) পাকিস্তানের লালসা মেটানোর হাতিয়ার হয়ে দেখা দিল। এর পাঁচ বছর পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান হুট করেই ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে বসল, যেটি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনিক মর্যাদা প্রশ্নে এই দুই দেশের মধ্যকার দ্বিতীয় সংঘাত।

জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান যে প্রাকৃতিক সম্পদ, সেই পানির একটা বিশাল অংশ পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করেছিল আইডব্লিউটি। ফলে ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখানে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়ে গেছে, যা সেখানে জনগণের মনে অসন্তোষ তৈরি করেছে। এবং যখনই জম্মু ও কাশ্মীরের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্য সিন্ধু চুক্তি মেনেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই পাকিস্তান সেটিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সব ধরনের কাজ করেছে। এখন জাতিসংঘ এ বিষয়ে নাক গলানোয় নতুন করে সংকট তৈরি হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে।

 ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক এবং ওয়াটার, পিস অ্যান্ড ওয়ার: কনফ্রন্টিং দ্য গ্লোবাল ওয়াটার ক্রাইসিস বইয়ের লেখক