মতামত

কম্বোডিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত কি পশ্চিমের দিকে ঝুঁকবেন

কম্বোডিয়ায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে যাচ্ছেন হুন সেনের বড় ছেলে হুন মানেত
ছবি : রয়টার্স

কম্বোডিয়ায় সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের জের ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আগামী মাসে হুন সেন সরে দাঁড়াচ্ছেন এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন তাঁর বড় ছেলে হুন মানেত। কম্বোডিয়া শুধু যে নতুন প্রধানমন্ত্রী পেতে যাচ্ছে, তা নয়, পুরো মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখ আসছে। এই নতুন মন্ত্রীদের একটি বড় অংশ তরুণ প্রজন্মের। হুন সেনের মন্ত্রিসভায় দীর্ঘদিন ধরে তাঁর যে সহকর্মীরা এত দিন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন, তাঁরাও হুন সেনের মতো বয়সে প্রবীণ। তাঁদের অনেককে এখন সরে যেতে হবে। সেখানে আসছেন হুন মানেত এবং তাঁর মতোই অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা।

এই তরুণদের অনেকেই হুন মানেতের মতো করে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এসেছেন। তাঁদের পূর্বসূরিদের মধ্যে পশ্চিমের বিষয়ে যে অনাগ্রহ আছে, তাঁদের মধ্যে সেটি না থাকা স্বাভাবিক। কম্বোডিয়ার নতুন ও অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব যদি পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হয়, তাহলে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। দেশটি তখন ভূরাজনীতির চেয়ে পুঁজি আকর্ষণের দিকে বেশি মনোযোগী হবে এবং সেগুলো হলে দেশটির কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের ছোঁয়া যুক্ত হতে পারে—এমন আশা করাই যায়।

গত রোববারের বিতর্কিত নির্বাচনে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি) পাঁচটি আসন বাদে সব কটিতেই জিতেছে। প্রধান বিরোধী দলকে অংশ নিতে না দিয়ে আয়োজন করা এই নির্বাচনটি আসলে সিপিপির ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানোর আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া যে আর কিছুই ছিল না, তা সবাই বুঝতে পারছেন। তবে এর মধ্য দিয়ে মন্ত্রিসভায় যে বিরাট পরিবর্তন আসছে, সেটিই প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা হুন সেন নিজের গদি ছেলে হুন মানেতের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পর দেশটি কী চীনা প্রভাব থেকে বেরিয়ে পশ্চিমা ভাবধারায় আগ্রহী হবে কি না, সেটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। নতুন যে মন্ত্রিসভা হতে যাচ্ছে, সেটি মূলত বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিজেদের ছেলেমেয়ে কিংবা ঘনিষ্ঠ স্বজনদের মন্ত্রিসভা হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রবীণ মন্ত্রীরা সরে গিয়ে তাঁদের ছেলেমেয়েদের সেখানে বসাতে যাচ্ছেন।

৪৫ বছর বয়সী হুন মানেত প্রথমে নিউইয়র্কের ওয়েস্ট পয়েন্টের মিলিটারি একাডেমিতে ও পরে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। এরও পরে তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। তিনি যখন কম্বোডিয়ার সেনাপ্রধান ছিলেন, তখন পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বেশ কয়েকটি সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সাবলীলভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন এবং তাঁর বাবার চেয়ে তাঁর পশ্চিমা আদবকায়দার ভাবমূর্তি বেশি উজ্জ্বল।

এ ক্ষেত্রে হুন সেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন; কারণ প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে সরে গেলেও তিনি ক্ষমতাসীন দল সিপিপির সভাপতি থাকছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হুন মানেত অনভিজ্ঞ হওয়ায় তাঁর পরামর্শক হিসেবেও তিনি কাজ করবেন। সে ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার শিগগিরই চীনপন্থী নীতি থেকে সরে আসার সম্ভাবনা কম বলেও অনেকে মনে করছেন।

চাই রিথাইসিন নামের যে নেতার পরবর্তী গ্রামীণ পরিকল্পনামন্ত্রী হওয়ার কথা, তিনি আমেরিকার অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমআইটিতে পড়াশোনা করেছেন। এ রকম আরও অনেক নতুন মন্ত্রী আসতে যাচ্ছেন, যাঁদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমাদের ওঠাবসা আছে। ফলে পশ্চিমাদের বিষয়ে কম্বোডিয়ার নীতিতে যৎসামান্য হলেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করা যেতে পারে।

মূলত ২০১৭ সালে হুন সেনের ক্ষমতাসীন দল তখনকার সবচেয়ে বড় বিরোধী দল কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টিকে (সিএনআরপি) বিলুপ্ত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কম্বোডিয়ার সম্পর্ক তলানিতে নেমে আসে। হুন সেন মনে করছিলেন, তাঁকে উৎখাত করতে যুক্তরাষ্ট্র সিএনআরপিকে নেপথ্য থেকে মদদ দিচ্ছিল।

এরপর নম পেন একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক মহড়া দেওয়া থেকে সরে আসে এবং সে বছরই তারা চীনের সঙ্গে সামরিক মহড়া দেওয়া শুরু করে। হুন সেন পুরোমাত্রায় চীনের বলয়ে ঢুকে পড়ে এবং বর্তমানে চীন তাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। কম্বোডিয়ায় নতুন এক্সপ্রেসওয়ে ও বন্দর তৈরিতে চীন শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। কম্বোডিয়ার দক্ষিণ উপকূলে একটি নৌঘাঁটি নির্মিত হচ্ছে। সেখানে চীনের সেনা মোতায়েনকে হুন সেন অনুমোদন দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হুন সেনের ওপর চটে আছে।

সর্বশেষ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘না অবাধ, না সুষ্ঠু’ নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছে। নির্বাচনে অনিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ কম্বোডিয়া থেকে মালামাল আমদানি অব্যাহত রেখেছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়াকে চাপে রেখে ওয়াশিংটনের আজ্ঞাবহ রাখতে চায় ও বেইজিংয়ের বলয় থেকে নম পেনকে বের করে আনতে চায়। সে ক্ষেত্রে হুন মানেত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ওয়াশিংটন এ বিষয়ে জোর উদ্যোগ নিতে পারে।

এ ক্ষেত্রে হুন সেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন; কারণ প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে সরে গেলেও তিনি ক্ষমতাসীন দল সিপিপির সভাপতি থাকছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হুন মানেত অনভিজ্ঞ হওয়ায় তাঁর পরামর্শক হিসেবেও তিনি কাজ করবেন। সে ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার শিগগিরই চীনপন্থী নীতি থেকে সরে আসার সম্ভাবনা কম বলেও অনেকে মনে করছেন।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

● ডেভিড হাট যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক ও কলাম লেখক