যে যুদ্ধের কথাই আপনি বলুন না কেন, যুদ্ধকালে মূল লড়াইটা হয় সেনাপতিদের মধ্যে আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রচেষ্টা থাকে সামরিক নেতৃত্বের পরামর্শগুলো উপেক্ষা করে চলা।
জর্জ ওয়াশিংটনের প্রসঙ্গ স্মরণ করা যাক। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ওয়াশিংটন তাঁর সেনাপতি চার্লস লিকে বিশ্বাস করতে পারেননি। ১৭৮২ সালে সামরিক আইনে বিচার হয়েছিল লির। আব্রাহাম লিংকনের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল, তিনি তাঁর সেনাপতিদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেও সেনাপতিদের নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আইজেনহাওয়ারকে প্রায়ই তাঁর ব্রিটিশ সহকর্মী, নির্দিষ্ট করে ফিল্ড মার্শাল স্যার বার্নাড মন্টগোমারির সঙ্গে বিরোধ বেধে যেত। ফলে তাঁকে এতটাই ছাড় দিতে হয়েছিল যে তাতে বেশ বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ানদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু স্তালিন ও তাঁর সেনাবাহিনী সেনাপতিদের বাগে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে স্তালিন তাঁর সেনাবাহিনীর কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন এবং তাঁদের গুলি করে হত্যা করেন। এমনকি মার্শাল গিওর্গি ঝুকভকেও শ্রমশিবিরে পাঠিয়েছিলেন। যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন হেরে যাওয়ায় তাঁকে শেষ মুহূর্তে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল।
সর্বোপরি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সুযোগসন্ধানী আর সেনাবাহিনী যদি চায় তাহলে পুতিনকেও তারা সরিয়ে দেবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ এখন পর্যন্ত পুতিনকে অনুসরণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু আগামীকাল কী ঘটবে, সেটা কেউ বলতে পারে? পুতিন পিগোশিন কিংবা গেরাসিমভ বা শোইগু কাউকেও বাদ দিতে পারবেন না। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়, সম্ভবত সেটা দেখতে চাইতে পারেন পুতিন। হতে পারে পিগোশিন দৃশ্যপট থেকে সরে যাবেন কিংবা আহত হবেন, আবার এমনও হতে পারে রাশিয়ার সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে ভালো আচরণ করছে।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যেও বর্তমানে একই ধরনের লড়াই চলাটা বিস্ময়কর কিছু নয়। তথ্য-প্রমাণ থেকে এটা পরিষ্কার যে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও তাঁদের কয়েকজনকে আবার ফিরিয়েও আনা হয়েছে।
ভাড়াটে সেনা দল ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিনের সঙ্গে রাশিয়ার সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর মধ্যে বিরোধ বেধেছে। এ ধরনের বিরোধ থাকলে খুব ভালোভাবে লড়তে সক্ষম একটি সেনাবাহিনীও বেকায়দায় পড়তে বাধ্য। ইউক্রেনে বাখমুত যুদ্ধে সেটাই দেখা যাচ্ছে। প্রিগোশিনের সঙ্গে রুশ সেনাপতিদের বিরোধ সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
বাখমুতের অভ্যন্তরে পিগোশিনের বাহিনী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং খুব ধীরে হলেও তাদের একটা ধারাবাহিক অগ্রগতি হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা তাদের নিজেদের বাহিনীকে শহরের মধ্যে আবর্তিত করতে এবং বাহিনীকে রসদ জুগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনীয় বাহিনীর সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা বাখমুতে প্রবেশের প্রধান সড়ক ও শাখা সড়কগুলোতে গুলি ও বোমাবর্ষণ করেছে। কিন্তু বাখমুতে অবস্থান নেওয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীর রসদ সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে দিতে পারেনি।
বাখমুতে সুদৃঢ় অবস্থান ধরে রাখার জন্য শহরটির উপকণ্ঠে এবং প্রবেশসড়কগুলোতে শক্তিশালী বাহিনী মোতায়েন করা প্রয়োজন ছিল রাশিয়ার। কিন্তু তারা সেটা না করে অপ্রশিক্ষিত সেনাদের এবং এমনকি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ দেয়। তাদের কাছে নিম্নমানের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদও দেওয়া হয়। রুশ বাহিনীর এই হতশ্রী অবস্থা ইউক্রেনীয় বাহিনীর শক্তি পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করেছে।
আজভ ব্রিগেডসহ বিভিন্ন বাহিনীর বিশেষ সেনাদের বাখমুত যুদ্ধে নিয়োজিত করে ইউক্রেন। ট্যাংকসহ সাঁজোয়া যান এ যুদ্ধে ব্যবহার করছে ইউক্রেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাশিয়ান সেনারা কেবল ছোট অস্ত্রে সজ্জিত এবং তাদের কোনো সাঁজোয়া যান ও ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র নেই। এর ফলাফল কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রিগোশিন রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশটির সামরিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করে বিবৃতি দিয়ে একটা বিশাল ভুল করে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপ ও রাশিয়ান সেনাবাহিনী পরস্পর বিচ্ছিন্ন সত্তা। কিন্তু তাই বলে কি বাখমুতে যাচ্ছেতাই একটা বাহিনী পাঠাবে রাশিয়া?
এ প্রশ্নে বিকল্প যুক্তি হলো, বাখমুতকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেনি রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ইউক্রেনীয় বাহিনীর দিক থেকে আসন্ন আক্রমণ প্রতিরোধেই তারা তাদের সব সম্পদ ও সেনাবল নিয়োগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই যুক্তি শুনতে আপনার ততক্ষণই যৌক্তিক বলে মনে হবে যতক্ষণ আপনি জানতে পারবেন না, একেবারে নবীন ও বাজে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নিজেদের বাহিনীকে পাঠিয়ে বাস্তবে কতটা বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ভাগনার গ্রুপের সেনাদের কতটা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে আসা হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী প্রায় অপরাধের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বসেছিল।
এই বিপর্যয়ের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন কথিত রাশিয়াপন্থী বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এই পশ্চাৎপসরণের পেছনে কারণ হলো, ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ফাঁদে ফেলে শেষ করে দেওয়া। কিন্তু এই বিশ্লেষকদের কথায় যুক্তির অভাব রয়েছে।
কিন্তু পুতিনের সামনে এখন বাস্তব সমস্যা রয়েছে। সামরিক অভিযান নিয়ে বাহিনীর মধ্যে কলহ-বিবাদ তৈরি হলে, নিজের বাহিনী গুটিয়ে নেওয়াটাই ভালো একটা পথ। এবং নিশ্চিতভাবেই পুতিন সেটা জানেন। কিন্তু পুতিনের মধ্যে আবার অনুসারীদের প্রতি আনুগত্যও আছে।
সের্গেই শোইগুর মতো তৃতীয় শ্রেণির মানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রতি আস্থাশীল পুতিন। বাস্তবে যুদ্ধ করার সামর্থ্য নেই শোইগুর, তিনি কোনো ভালো কৌশলনীতিবিদও নন। নিজের ভালো বন্ধু পিগোশিনের প্রতিও অনুগত পুতিন। একদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ান বাহিনীর ব্যর্থতার জামিনদার হিসেবে প্রিগোশিনকে ব্যবহার করছেন পুতিন, অন্যদিকে ভাগনার গ্রুপের সেনা দলকে সিরিয়া ও আফ্রিকায় নিয়োগ করছে।
সর্বোপরি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সুযোগসন্ধানী আর সেনাবাহিনী যদি চায় তাহলে পুতিনকেও তারা সরিয়ে দেবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ এখন পর্যন্ত পুতিনকে অনুসরণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু আগামীকাল কী ঘটবে, সেটা কেউ বলতে পারে? পুতিন পিগোশিন কিংবা গেরাসিমভ বা শোইগু কাউকেও বাদ দিতে পারবেন না। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়, সম্ভবত সেটা দেখতে চাইতে পারেন পুতিন। হতে পারে পিগোশিন দৃশ্যপট থেকে সরে যাবেন কিংবা আহত হবেন, আবার এমনও হতে পারে রাশিয়ার সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে ভালো আচরণ করছে। এ সবকিছুর উপরেই ইউক্রেন যুদ্ধের গতিমুখ নির্ভর করছে।
স্টিফেন ব্রায়েন, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত