যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

ইয়ান বুরুমার বিশ্লেষণ

ট্রাম্পবিরোধীরা সরব হবেন, নাকি চুপ থাকবেন

ইতিহাসবিদেরা দাবি করেছেন, একজন ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসকের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে, তার প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে আছে। মুক্ত গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্রের মতো যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর একটি উদার গণতন্ত্র টিকে থাকে, সেগুলোর সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের যে তেমন কোনো আগ্রহ নেই, তা তিনি তাঁর কথা ও কাজে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

ট্রাম্পের কাজকারবার আমেরিকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শেষ পর্যন্ত দুর্বল করে দেবে কি না, তা নির্ভর করছে আমেরিকার জনগণ গণতন্ত্র রক্ষায় কতটা প্রস্তুত—তার ওপর।

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের কাজে বিরোধী আইনপ্রণেতারা বাধা হয়ে দাঁড়ালে হতাশ হয়ে ৩ ডিসেম্বর তিনি আচমকা সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণার প্রতিবাদে রাজপথে এবং পার্লামেন্টে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ শুরু হয়। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে তাঁর নিজ দলের লোকেরাও ছিলেন। ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে ইউন তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

আমরা আশা করতে পারি, আমেরিকায় ট্রাম্প যদি এই ধরনের কোনো খামখেয়ালি পদক্ষেপ নেন, তাহলে জনগণ একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

আশার কথা, যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বৈরতন্ত্র থেকে অনেক দূরে। তবে কিছু মানুষ ইতিমধ্যে ট্রাম্পকে একজন রাজাধিরাজের মতো শাসক হিসেবে তুলে ধরা শুরু করে দিয়েছেন। তাঁদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প যেন একজন সম্রাট; তিনি যেন একজন নির্বাচিত নেতা নন।

যেমন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়াশিংটন পোস্ট–এর মালিক জেফ বেজোস তাঁর পত্রিকার সম্পাদকদের কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সমর্থন করতে দেননি।

উপস্থাপক জো স্কারবরো এমএসএনবিসির অনুষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলে সমালোচনা করে এলেও নির্বাচনের পরপরই তিনি ফ্লোরিডায় গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মিটমাট করে এসেছেন।

রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতা ট্রাম্পকে আগে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করলেও এখন সুবিধা নেওয়ার জন্য তাঁকে সমর্থন করছেন।

যেমন সিনেটর মার্কো রুবিওর কথা বলা যায়। তিনি একসময় ট্রাম্পকে ‘প্রতারক’ বলেছিলেন। সেই তিনিই এখন ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন। আর যে জেডি ভ্যান্স একসময় ট্রাম্পকে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, সেই ভ্যান্স তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।

এর মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক সময় নীতি ও নৈতিকতাকে হার মানায়। 

এখন দেখার বিষয়, রিপাবলিকানদের মধ্যে কেউ নৈতিকতার পক্ষে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ান কি না।

একজন দুর্নীতিগ্রস্ত এবং প্রতিশোধপরায়ণ প্রেসিডেন্টের মোকাবিলা করায় যেহেতু অনেক ঝুঁকি থাকে, সেহেতু তাঁকে মোকাবিলার আরেকটি পদ্ধতি হলো ‘অভ্যন্তরীণ অভিবাসন’ নামে পরিচিত একটি পন্থা বেছে নেওয়া।

নাৎসি জার্মানিতে কিছু লোক ঝামেলা এড়ানোর জন্য এভাবে দলের মধ্যে থেকে হিটলারের কোনো কাজের সমালোচনা না করে ‘মাথা নিচু করে’ নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। 

ট্রাম্পের নির্বাচনের পর অনেক আমেরিকান ক্লান্ত ও হতাশ বোধ করছেন। ২০১৬ সালের তুলনায় এখন ট্রাম্পের বিরোধিতায় মানুষের আগ্রহ কম বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই খবর পড়া বা টিভিতে নিউজ দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন।

জনজীবন থেকে সরে গিয়ে নিজের নিরাপত্তার খোঁজ করাটা হয়তো নিজের জন্য আরামদায়ক মনে হতে পারে, কিন্তু এর ফলে আমেরিকার সক্রিয় নাগরিক সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

যেসব টিভি চ্যানেল ট্রাম্পের সমালোচনা করে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া, তাঁর সমালোচনা করা সাংবাদিকদের জেলে পাঠানো এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ‘ওয়াক’ (ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ‘ওয়াক’ প্রতিষ্ঠান হলো সেসব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা সংগঠন, যেগুলো সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতার প্রশ্নে সচেতন বা এ নিয়ে শিক্ষাদান করে। ট্রাম্প মনে করেন, এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর মতাদর্শের বিরোধিতা করে) মনে করেন, সেগুলোকে জরিমানা করার হুমকি দিয়েছেন। 

নিউইয়র্ক টাইমস–এর একজন রুশ সাংবাদিক উল্লেখ করেছিলেন, তৃতীয় রাইখের অধীনে থাকা জার্মানদের মতো প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অধীনে থাকা রুশ নাগরিকেরা দ্রুতই বুঝে ফেলেছেন, তাঁরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু রাজনীতি তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। 

আমেরিকানরা যদি ধরে নেন ইতিমধ্যে তাঁরা একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করছেন, তাহলে সেটি তাঁদের জন্য একটি বড় ভুল হবে। প্রকৃত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধীরা বরাবরই এর উল্টো আচরণ করে।

উদাহরণস্বরূপ ভ্যাক্লাভ হাভেলের কথা বলা যেতে পারে। তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার বিশিষ্ট নাট্যকার ও কমিউনিস্ট শাসনের সময় বিরোধী দলের রাজনীতিক ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তো, তিনি কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে জীবনের সবকিছু ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিলেন এবং বহুবার জেলে গিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর মতানুসারীরা ঠিক করেছিলেন, তাঁরা একটি অগণতান্ত্রিক সমাজে থেকেও স্বাধীন মানুষের মতো আচরণ করবেন। হাভেল এটিকে বলেছিলেন ‘সত্যে বাঁচা’। এটি ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ না করার একধরনের সংকল্প।

ট্রাম্প গণমাধ্যম আর উদারপন্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর খুব চটেছেন। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর মিথ্যা আর খারাপ দিকগুলো প্রকাশ করতে পারে।

যেসব টিভি চ্যানেল ট্রাম্পের সমালোচনা করে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া, তাঁর সমালোচনা করা সাংবাদিকদের জেলে পাঠানো এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ‘ওয়াক’ (ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ‘ওয়াক’ প্রতিষ্ঠান হলো সেসব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা সংগঠন, যেগুলো সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতার প্রশ্নে সচেতন বা এ নিয়ে শিক্ষাদান করে। ট্রাম্প মনে করেন, এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর মতাদর্শের বিরোধিতা করে) মনে করেন, সেগুলোকে জরিমানা করার হুমকি দিয়েছেন। 

‘ওয়াক’ শব্দের মানে অস্পষ্ট, তাই যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাঁর টার্গেট হতে পারে।

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় আর সংবাদমাধ্যমগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা বলা কঠিন। শাস্তির ভয়ে অনেকে নিজেদের কথা বলা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারেন; অর্থাৎ ‘সত্যে বাঁচা’র বদলে চুপ থাকতে পারেন। আবার কেউ কেউ ট্রাম্পবিরোধী রাগ আর হতাশা থেকে ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের অপছন্দের বিষয়গুলো আরও বেশি সামনে আনতে পারেন (যেমন বর্ণ, লিঙ্গ বা যৌনতার সমতা প্রশ্নে আরও উচ্চকিত হতে পারে)। 

তবে এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই ট্রাম্পের পক্ষে যাবে। চুপ থাকার মানে হবে তাঁর মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে কমজোরি করে ফেলা। আর অতিরিক্ত উচ্চকিত প্রতিক্রিয়া দেখালে ডানপন্থীদের মনে হতে পারে, তাঁদের ‘সংস্কৃতির লড়াই’ সঠিক। ‘সংস্কৃতির লড়াই’য়ে ট্রাম্পের অনুসারীরা সহজেই জিতবেন; কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীল মানুষের সংখ্যা বেশি এবং বড় শহরের বাইরের এলাকায় পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি তেমন জনপ্রিয় নয়।

সে কারণে ট্রাম্পের মতো স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির মোকাবিলা করার সেরা উপায় হলো আদর্শগত লড়াই বাদ দিয়ে সত্যের পথে থাকা। খোলা আলোচনার মাধ্যমে সত্য খোঁজা, একাডেমিক স্বাধীনতা বজায় রাখা, আর সৎ ও নিরপেক্ষ রিপোর্ট করা উচিত। এটাই সাংবাদিক আর শিক্ষকদের আসল কাজ হওয়া উচিত হবে।

ট্রাম্প এবং অন্যান্য স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ঝুঁকে থাকা জনতুষ্টিবাদী নেতাদের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক তাঁদের মিথ্যা নয়। কারণ, মিথ্যা কিছুটা হলেও সব রাজনীতিবিদ বলে থাকেন। তবে আরও বেশি বিপজ্জনক হলো এই ধারণা যে সত্যের কোনো মূল্য নেই।

যদি আমরা ধরে নিই সত্য বলতে কিছু নেই; সত্যের প্রতিটি দাবি আপেক্ষিক, পক্ষপাতদুষ্ট বা মতভেদপূর্ণ, তাহলে এটি আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান এ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ফলে একজন স্বৈরাচারী নেতার পক্ষে তাঁর নিজের মিথ্যাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ হয়ে যাবে। আর এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।

ইয়ান বুরুমা বিশিষ্ট লেখক, ইতিহাসবিদ ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষক।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ