অথচ গ্রামেরও কিছু বলার ছিল। কথা ছিল, প্রযুক্তি আমাদের সবাইকে আরও কাছাকাছি করবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। আমাদের তাই শারীরিকভাবেই পাশাপাশি থাকতে হবে। জুম মিটিং নয়, মাঠের ঘাসই আমাদের ভবিষ্যৎ। বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ চাইলে মফস্সলের মুখ লাগবে। মফস্সলের বইমেলা হলো সেই মুখগুলোর মিলিত স্বর।
ঢাকায় বইমেলা শুরু হয়েছে ষাটের দশকে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের আগে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে বইমেলারও সম্পর্ক রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের জন্য জাতীয় জাগরণ জরুরি। স্বাধীনতার পর একুশের বইমেলা অনেক ক্ষেত্রেই সেই ভূমিকাটা পালন করেছে। কিন্তু সেটা রাজধানীকেন্দ্রিক। গ্রাম জাগার জন্য চাই গ্রামের বইমেলা।
কুড়িগ্রামের চিলমারী নদীবন্দরে পণ্ডিত বইমেলা, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বইমেলা কয়েক বছর ধরে হয়ে আসছে। এই দুই বইমেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজস্বতা টের পাওয়া গেলেও প্রকাশনার ক্ষেত্রে নিজস্বতা অনুপস্থিত।
এই দুই মেলা ছাড়া মফস্সলের আর কোনো বইমেলা নির্দিষ্ট তারিখে অনুষ্ঠিত হয় না। নির্দিষ্ট সময়ে মেলা হলে তার জন্য প্রস্তুতি শুরু হয় কয়েক মাস আগে থেকেই। সেই প্রস্তুতি পাঠক, লেখক, অংশগ্রহণকারী সবারই। প্রকাশকেরাও পরিকল্পনাটাও সেভাবেই সাজান। পণ্ডিত বইমেলার মতো সবাই যখন জানবেন বইমেলা নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হবে, রাষ্ট্রের কর্তাদেরও তখন সহযোগিতার মনোভাব প্রস্তুত রাখতেই হবে।
এসব বইমেলাকে কেন্দ্র করে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা নতুন শিল্পীর জন্মকেও সহজ করে তুলবে। স্থানীয় সমাজ থেকে শিল্পী যে ধরনের মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি পান, তা ঢাকার গণমাধ্যমসৃষ্ট খ্যাতি থেকে ভিন্ন। এখানে কল্পনার সেলিব্রিটি জন্ম নেয় না।
এখানে একজন ভূপতিভূষণ, অনন্তকুমার দেব শুধু ভাওয়াইয়ার সাধক হিসেবে সম্মানিত হন না; একজন শিক্ষক হিসেবে, সংগঠক হিসেবেও সমাদৃত হন। এখানে যাঁরা আয়োজক, যাঁরা শ্রোতা ও যাঁরা শিল্পী, সবাই গুরুত্বপূর্ণ। এ এক অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি।
বাংলাদেশ একটি বহুজাতির দেশ। একেকটি জেলায় গড়ে ২৫ লাখ মানুষের বাস। কিন্তু ভাওয়াইয়া-রাজবংশী ভাষায় সাহিত্য যেমন দাঁড়ায়নি, তেমনি চাকমা, সাঁওতালদেরও ভাষার সাহিত্যও এখানে দাঁড়ায়নি। একুশে বইমেলা যেমন বাঙালি জাতির মননের প্রতীক, তেমনি অন্যান্য জাতিসত্তার মননের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে মফস্সলের বইমেলাগুলো।
দৃষ্টান্ত হিসেবে চিলমারীর পণ্ডিত বইমেলার কথা বলা যাক। চারটি কলেজ ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসহ ২৪টি হাইস্কুল-মাদ্রাসা, উপজেলা হাসপাতাল ও ৪০ থেকে ৫০টি ক্লিনিক, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, মৎস্য অফিস, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসসহ ২০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩০ থেকে ৪০টি এনজিও অফিস, সমাজসেবা, কৃষি অফিস, নির্বাচন অফিস, থানা, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের অফিসসহ কিশোর-কিশোরী ক্লাবগুলো, ৬টি ইউনিয়ন পরিষদ, রেডিও চিলমারী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিআইডব্লিউটিএ, নৌ থানা, আবগারি ও শুল্ক অফিস, রেলস্টেশনসহ প্রায় সাড়ে তিন শ প্রতিষ্ঠান আছে শুধু চিলমারীতে।
এই সাড়ে তিন শ প্রতিষ্ঠান গড়ে পাঁচ হাজার টাকার বই কিনলে ২০ লাখ টাকার বই বিক্রি হবে শুধু একটি উপজেলায়ই। গোটা কুড়িগ্রাম জেলায় হবে দুই কোটি টাকার ওপর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন মেটাবে না। আমাদের গভীরতর বোধ জেগে উঠবে কেবল সরাসরি আড্ডাতেই। সামাজিক বন্ধনের পুনরুজ্জীবন কেবল মফস্সলের বইমেলাগুলোই ঘটাতে পারে। কারণ, এখনো মফস্সলে বড়রা ছোটদের বই উপহার দেন। মেলা মানে উপহার বিনিময়। মেলা মানে কিশোর-তরুণদের সমাজের সঙ্গে যুক্ত করা। তাদের সামাজিক হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশে বই বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ঢাকা ও বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক। জেলা–উপজেলায় এখন মূলত গাইড ও নোট বই বিক্রি হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে প্রচুর বই বিক্রি হয়। কিন্তু যাঁরা বই কেনেন, তাঁরা মূলত পুরোনো পাঠক। এ প্রেক্ষাটে মফস্সলের বইমেলা কয়েক গুণ নতুন পাঠক সৃষ্টি করতে পারে। তাতে জেলাব্যাপী বই বিপণনের নেটওয়ার্ক তৈরি হতে পারে। মানে বইয়ের নতুন বাজার তৈরি হতে পারে।
যে পাঠকেরা রাজধানীর একুশে বইমেলায় গিয়ে বই কিনতে পারেন না, মফস্সলের বইমেলায় তাঁরা বই কিনবেন। স্থানীয় লেখকেরাও সেই বাজার তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন। কোনো কোনো লেখক যেমন দেশব্যাপী পরিচিত ও জনপ্রিয়, তেমনি স্থানীয়ভাবেও কিছু লেখক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারবেন। লিখে যে পেট চালানো যায়, এই পরিস্থিতি তৈরি হতেও বেশি সময় লাগবে না। মূল কথা হলো বইকে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।
মফস্সলের লেখকেরা রাজধানীর বইমেলায় যে গর্বিত ভঙ্গিতে হাজির, নিজ গাঁয়ের সুখ-দুঃখ নিয়ে মফস্সলে তাঁরা অনুপস্থিত। গাঁয়ের পাঠকেরা প্রচুর বই কেনেন, কিন্তু লেখকেরা এসব বইমেলায় বই প্রকাশ ও মোড়ক উন্মোচনে অনাগ্রহী। অথচ আঞ্চলিক লেখকদের বই এখানেই মূলত বিক্রি হয়। তবু মফস্সলের লেখকদের ঢাকার স্বীকৃতি যেন লাগবেই।
জেলা সাহিত্য সম্মেলনগুলোয় দেখা গেছে, জেলাপ্রতি হাজারজনা লেখক আছেন। নিজ নিজ জেলার বইমেলা নিয়ে তাঁরা উচ্ছ্বাসহীন। তার মানে, লাখ লাখ পাঠকের ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন মেটাবে না। আমাদের গভীরতর বোধ জেগে উঠবে কেবল সরাসরি আড্ডাতেই। সামাজিক বন্ধনের পুনরুজ্জীবন কেবল মফস্সলের বইমেলাগুলোই ঘটাতে পারে। কারণ, এখনো মফস্সলে বড়রা ছোটদের বই উপহার দেন। মেলা মানে উপহার বিনিময়। মেলা মানে কিশোর-তরুণদের সমাজের সঙ্গে যুক্ত করা। তাদের সামাজিক হয়ে ওঠা।
● নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক এবং আহ্বায়ক, পণ্ডিত বইমেলা, চিলমারী, কুড়িগ্রাম
nahidknowledge1@gmail.com