মতামত

যুক্তরাষ্ট্র কি রাজনৈতিক বৈরিতা থেকে নতুন শ্রমনীতি করেছে

সাম্প্রতিক মজুরি আন্দোলনে চারজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ৬২টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৩ হাজারের বেশি শ্রমিককে।
ছবি : প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম নীতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর মূলত একই সূত্রে গাঁথা। এ যোগসূত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট আছে। রানা প্লাজা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সেটি গভীরভাবে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে মজুরি বৃদ্ধির সময় শ্রমিক আন্দোলনের ওপর যে দমন-পীড়ন হয়েছিল, সেটিও যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার এবং নতুন বাণিজ্য নীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। যাঁরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতি এবং বাংলাদেশের মজুরি আন্দোলনের মধ্যে সম্পর্ক ‘কাকতালীয়’, তাঁরা মূলত সমস্যার মূল কারণকে হয় বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তা না হলে আড়াল করার চেষ্টা করছেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতি এবং ইইউ প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরপরবর্তী প্রতিবেদন বাংলাদেশের বাণিজ্য-রপ্তানির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটি জানতে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে? সরকার ও কারখানার মালিকেরাই-বা কী ভাবছেন?

অনেকেই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতি ‘কাকতালীয়’ একটি ব্যাপার এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার বৈরী রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে এটি হচ্ছে।

মালিকেরা বলছেন, পশ্চিমা ক্রেতা ও শ্রমিক সংগঠনের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সুপারিশের ভিত্তিতে কারখানার কর্মপরিবেশের ‘ব্যাপক’ উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনেক সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। আমাদের কোনো ‘দুর্বলতা’ নেই। ফলে বাণিজ্য নীতির কারণে রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে—এই ভয় পাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

উল্টো তাঁরা শ্রমিকনেতাদের সম্পর্কে অভিযোগ করছেন, এ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হোক, ‘শ্রমিকনেতা নামধারীরা’ সেটা চান না এবং তাঁরা নানা রকম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পোশাক খাতকে অশান্ত করছেন। সর্বোপরি মালিকেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমমান–সম্পর্কিত স্মারকটি (প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এটি সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য না–ও হতে পারে। (বণিক বার্তা, ১৯ নভেম্বর ২০২৩)।

আইএলওর ১০৪ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১৩ থেকে ১৪টি দেশের ক্ষেত্রে তদন্ত কমিশন হয়েছে। এটি আইএলওর কোনো সদস্যরাষ্ট্রের ওপর সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এ থেকে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার পরিস্থিতি ভেতরে-ভেতরে কতটা নাজুক।

ঢাকা-ওয়াশিংটন রাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা হয়তো ভালোভাবে বলতে পারবেন। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শ্রমনীতি হয়েছে—এমনটা অনুমান করে বসে থাকলে সবচেয়ে বড় ভুল হবে। প্রকারান্তরে তা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে।

অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কারণে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ও কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি হয়েছে, সেটা ঠিক। কিন্তু যে বিষয়ে কার্যকর কোনো অগ্রগতি হয়নি, তা হলো শ্রমিকের অধিকার। বিশেষ করে শ্রমিকের সংগঠিত হওয়া এবং যৌথ দর-কষাকষির অধিকার–সম্পর্কিত বিষয়ে (কংগ্রেসনাল রিপোর্ট, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)। অথচ বিষয়টি আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের মৌলিক ভিত্তি।

১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ৮টি মূল সনদের ৭টিতে অনুস্বাক্ষর করে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন পৃথিবীতে যে ১০টি দেশে ঠিকমতো হয় না এবং শ্রমিক অধিকার পরিস্থিতি যে ১০টি দেশে খুব খারাপ, তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম দিকে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের এই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন, ৬ জুন, ২০২৩)।

আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের এই লঙ্ঘনের একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশের জন্য আইএলওর তদন্ত কমিশন (কমিশন অব ইনকোয়ারি) গঠন। ২০১৯ সালের ৩০ জুন যেটি শুরু হয়েছে।

আইএলওর ১০৪ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১৩ থেকে ১৪টি দেশের ক্ষেত্রে তদন্ত কমিশন হয়েছে। এটি আইএলওর কোনো সদস্যরাষ্ট্রের ওপর সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এ থেকে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার পরিস্থিতি ভেতরে-ভেতরে কতটা নাজুক।

এই তদন্ত কমিশন হয়েছিল মূলত ২০১৮ সালের মজুরি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। তখন শ্রমিক নিহত হওয়া, শ্রমিকনেতাদের ওপর হয়রানি ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার মতো ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশ শ্রম পরিস্থিতি সম্পর্কে এই কমিশনের প্রধান অভিযোগ ছিল—বাংলাদেশ তিনটি সনদের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনি। এই তিন সনদ হলো সনদ ৮৭ (সংগঠন করার অধিকার সনদ), সনদ ৮৮ (সংগঠিত হওয়া এবং যৌথ দর-কষাকষির অধিকার) এবং সনদ ৮১ (শ্রম পরিদর্শন)।

আইএলওর তদন্ত কমিশনের কাছে বাংলাদেশ চারটি প্রধান বিষয় অঙ্গীকার করেছিল। এক. শ্রম আইন সংশোধন, দুই. ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ; তিন. শ্রম পরিদর্শনের ব্যবস্থা জোরদারকরণ; চার. ইউনিয়ন কার্যক্রমের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ/অসৎ শ্রম আচরণ এবং শ্রমিকদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ।

কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর শ্রম সম্মেলনে তারা বাংলাদেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশ প্রতিবছরই অগ্রগতি সাধনের (আইএলও নরমলেক্স) অঙ্গীকার করে আসছে। কিন্তু কার্যত এসব বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক মজুরি আন্দোলনে চারজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ৬২টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৩ হাজারের বেশি শ্রমিককে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২০ জনকে। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৫ নভেম্বর, ২০২৩ )। এ ছাড়া ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে শ্রম আইন পাস করা হয়েছে। সেখানে শ্রমিক সংগঠনের মতামতকে উপেক্ষা করেই এ আইন অনুমোদন করা হয়েছে। (সূত্র: ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিবৃতি, ৩৪৯তম আইএলও গভর্নিং বডি বৈঠক)

ফলে, এ বছর মার্চ মাসে আইএলওর পরিচালনা পরিষদের (গভর্নিং বডি) কাছে বাংলাদেশ যে চারটি প্রধান বিষয়ে অগ্রগতির অঙ্গীকার করেছিল, ২০২৩ সালের মজুরি আন্দোলন এবং একতরফাভাবে শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেই অঙ্গীকারের ১, ৩ ও ৪ নম্বর অঙ্গীকারের বরখেলাপ করা হয়েছে। ফলে বিজিএমইএর নেতারা যে বলছেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদ মেনে কারখানাগুলো পরিচালিত হচ্ছে, কোনো দুর্বলতা নেই, সেটার বাস্তব ভিত্তি কতটুকু?

১২-১৫ নভেম্বর ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের (ইইএএস) এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা পাম্পালোনির নেতৃত্বে একটি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। এই সফরে তাদের উদ্দেশ্য ছিল আইএলও গভর্নিং বডির কাছে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকারবদ্ধ রোডম্যাপের (চারটি অঙ্গীকার) ওপর ভিত্তি করে গঠিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনার (২০২১-২৬) অগ্রগতি পর্যালোচনা করা।

ইইউ প্রতিনিধিদল সফর শেষে বিজিএমইএর নেতাদের বলেছে, শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়ে ধীরগতিতে তারা অখুশি (ডেইলি স্টার, ১৫ নভেম্বর ২০২৩)।

বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এসব দেশের পাঁচটি শ্রমিক অধিকার সংস্থা (এর সঙ্গে দুই শতাধিক পোশাক ক্রেতা সংশ্লিষ্ট। প্রায় ২ হাজার ৯০০টি বাংলাদেশি কারখানা থেকে এই ক্রেতারা পোশাক কেনে) বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করেছে ঘোষিত মজুরি পুনর্নির্ধারণ এবং শ্রমিকদের সংগঠন, ধর্মঘট ও প্রতিবাদ করার অধিকারকে সম্মান প্রদর্শন করতে (প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর ২০২৮)।

এসব সংস্থা মূলত আন্তর্জাতিক শ্রমমানের ভিত্তিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
শ্রমিকের মজুরি এমনভাবে নির্ধারণ করা দরকার, তা যেন তাঁদের জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত হয় এবং মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংস্থাগুলো বলেছে, মজুরির জন্য যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে, তা ভাগাভাগি করা হবে।

সুতরাং শ্রমিকের মজুরি পুনর্বিবেচনা করা, শ্রমিকনেতাদের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ করা, নিহত শ্রমিকদের সুবিচার নিশ্চিত করা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন—এসবই হতে পারে এই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্যনীতি বা নিষেধাজ্ঞা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ।

  • জাফর ইকবাল পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া

  • ড. দেলোয়ার হোসেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড পলিসি অ্যানালিস্ট, ইউনিভার্সিটি অব টেনেসি

  • কনক বর্মণ শ্রম সংগঠক এবং আমার শ্রম, আমার লড়াই, লেবার এডুকেশন প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা