হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানোর আগে রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি তথ্য দিতে হয়। জরুরি মুহূর্তে এসব তথ্য দেওয়ার ঝামেলা কারোই পোহাতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু রোগীর যদি আগেই রেজিস্ট্রেশন করা থাকত, তাহলে খুব সহজে হাসপাতাল নম্বর বা পেশেন্ট আইডি দিলে সব তথ্য চলে আসত, বারবার সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে এই পদ্ধতি ইতিমধ্যে চলমান। কিন্তু এর চেয়েও ভালো হতো একটি হাসপাতাল আইডি দিয়ে যদি দেশের সব কটি হাসপাতালে দ্রুততার সঙ্গে ভর্তি করিয়ে নেওয়া যেত।
এবার এ প্রক্রিয়া অনলাইনে অর্থ লেনদেন করার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যাক। কেনাকাটা করতে গেলে অথবা কাউকে টাকা পাঠাতে গেলে বারবার অ্যাকাউন্টের নাম, নম্বর, রাউটিং নম্বর, ক্রেডিট কার্ড হলে কার্ড নম্বর, কার্ডের মেয়াদ ইত্যাদি তথ্য প্রদান শুধু ঝামেলাদায়কই নয়, গুরুত্বপূর্ণ এই আর্থিক ডেটা যেখানে সেখানে সরবরাহ করা অনিরাপদও বটে। ঠিক এ জায়গায় এসেই আর্থিক খাতে বিশ্বব্যাপী নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে পেপ্যালের মতো সেবাগুলো।
একটিমাত্র ই–মেইল ঠিকানার (বা ফোন নম্বর) মাধ্যমে লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে পেপ্যাল। সে ই–মেইলই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আইডি। অনলাইনে বা অ্যাপের মাধ্যমে পেপ্যাল দিয়ে টাকা পাঠানো, বলতে গেলে জিমেইল ব্যবহার করে ই–মেইল পাঠানোর মতোই সহজ। পেপ্যাল অ্যাকাউন্ট তৈরি করার সময় একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা কার্ডের সঙ্গে পেপ্যালকে সংযুক্ত করে নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে সে ব্যাংক বা কার্ডের তথ্য বারবার দেওয়া ছাড়াই নিরাপদে করা যায় লেনদেন, পরিশোধ করা যায় পণ্য বা সেবার মূল্য।
বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে পেপ্যালের সার্ভিস চালু আছে এবং লেনদেন হয় ২৫টির বেশি মুদ্রায়। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সচল পেপ্যাল অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৩ কোটি। প্রতিদিন পেপ্যালের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ৪ কোটির বেশিসংখ্যক লেনদেন। অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ বাজারের ৪৩ দশমিক ৮৫ ভাগ রয়েছে পেপ্যালের দখলে। বিশ্বের ১ কোটি ৬৮ লাখের বেশি ওয়েবসাইট পেপ্যালের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৭১ ভাগ ই-কমার্স সাইট পেপ্যালের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সুযোগ রেখেছে। (সূত্র: জিপ্পিয়া ডটকম)
বিশ্বব্যাপী পেপ্যাল বা সমজাতীয় আরও বেশ কিছু সেবা রয়েছে। তার কয়েকটির তুলনায় পেপ্যাল ব্যয়বহুল। পেপ্যালের মাধ্যমে টাকা স্থানান্তর করতে হলেও প্রাপক ও প্রেরক উভয়ের পেপ্যাল অ্যাকাউন্ট থাকা প্রয়োজন হয়। এসব অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন লেনদেনে যে জিনিসটি অন্যতম জরুরি, সেই ‘আস্থা’ বা ‘বিশ্বাস’ অর্জনের সুবাদে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে পেপ্যাল।
বাংলাদেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে। এই ফ্রিল্যান্সাররা বহুদিন ধরে আকুতি জানিয়ে আসছেন লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে পেপ্যাল যেন চালু হয়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হলেও দুই শতাধিক দেশে চলমান এই সেবা হতাশাজনকভাবে এখনো চালু হয়নি বাংলাদেশে। দেশের বহুল প্রচারিত ‘ঘরে বসে আয়’ নামক স্লোগান আমরা প্রচার করা শুরু করে দিলেও অন্যতম স্বীকৃত মাধ্যমে সেই আয় আনার ব্যবস্থা আমরা করতে পারছি না। দায়িত্বশীল কোনো জায়গা থেকে চালু না হওয়ার কারণও স্পষ্ট করা হয়নি।
এ কথা ঠিক যে পেপ্যালের এ দেশে আসা শুধু আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না। পেপ্যালের ব্যবসায়িক কৌশল, বাজারের আকার, তাদের লাভ-ক্ষতির হিসাব, ঝুঁকির আশঙ্কা ইত্যাদির ওপরও নির্ভর করে। সঙ্গে সঙ্গে নির্ভর করে আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মুদ্রানীতির ওপরও। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইসিটি ডিভিশন, বিভিন্ন অংশীজনসহ সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় কি না, সেই প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। নীতিগত কোনো বাধা থাকলে বিশ্বের সিংহভাগ দেশে যে পদ্ধতিতে এটি পরিচালিত হয়, আমরা কেন সেভাবে সমন্বয় করতে পারব না? উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে উপাত্ত বা অবকাঠামো দেশের সীমানায় রাখার বাধ্যবাধকতা দেওয়ায় তুরস্কে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল পেপ্যাল (সূত্র: টেকক্রাঞ্চ)।
আমাদের মুঠোফোন গ্রাহক, ইন্টারনেট গ্রাহক, ই–কমার্সের প্রসার ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ পেপ্যালের জন্য যে বড় ধরনের এক বাজার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পেপ্যাল ছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই—ব্যাপারটি তা নয়, সব ক্ষেত্রে পেপ্যালই যে সেরা সমাধান, সেটিও নয়। কিন্তু যে সেবা বিশ্বের এতগুলো দেশে বিদ্যমান, তুলনামূলকভাবে যে সেবা সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ, যে সেবা বিশ্বজুড়ে গ্রাহকদের কাছে গ্রহণযোগ্য, সেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বা ক্যাশলেস সোসাইটির পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকা একটি দেশে থাকবে না, সেটি কেমন যেন বেমানান, কেমন যেন অগ্রহণযোগ্য।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বহু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি। একবার তো ‘জুম’ দিয়ে পেপ্যালের কাজ চালানোর আওয়াজও উঠল। পেপ্যাল যেখানে অনলাইন পেমেন্ট পরিষেবা, বলা চলে জুম সেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের পরিষেবা মাত্র। দুধের স্বাদ ঘোল দিয়ে যেমন মেটানো যাবে না, পেপ্যালের কাজও তেমনি জুম দিয়ে করা যাবে না। আমাদের প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে বাইরের একজন ক্রেতাকে পেপ্যাল বাদ দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলা, ই–মেইল বাদ দিয়ে ডাকযোগে চিঠি পাঠাতে বলার মতোই পীড়াদায়ক।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
bmmainul@du.ac.bd