বাশার আল–আসাদ পালিয়ে যাওয়ায় সিরিয়ায় শুধু বাথ পার্টির শাসনেরই অবসান ঘটেনি, একই সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধে ইরান ও রাশিয়ারও পরাজয় ঘটেছে।
বাশার আল–আসাদ পালিয়ে যাওয়ায় সিরিয়ায় শুধু বাথ পার্টির শাসনেরই অবসান ঘটেনি, একই সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধে ইরান ও রাশিয়ারও পরাজয় ঘটেছে।

মতামত

সিরিয়ায় বাশারের পতন: ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও বিদ্রোহীদের স্বার্থ যেখানে এক হলো

সিরিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠী তাহরির আল–শামের হাতে বাথ পার্টির ৬১ বছরের শাসনের অবসান হলো। ১৯৬৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭১ সালে বাশার আল–আসাদের বাবা হাফিজ আল–আসাদ পার্টির ভেতরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আমিন আল–হাফিজের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। হাফিজ আল–আসাদের মৃত্যুর পর বাশার আল–আসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন ২০০০ সালে।

২০১১ সালে শুরু হওয়া ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে রোববার বাশার আল–আসাদ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। গত এক সপ্তাহের একপক্ষীয় যুদ্ধে হুড়মুড় করে বাশারের শাসনের পতন ঘটল। এক রকম বিনা বাধায় এইচটিএসের যোদ্ধারা একের পর এক দখল নিচ্ছিলেন বাশারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন শহরের।

গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাশার আল–আসাদ ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে বিদ্রোহীদের পিছু হটিয়ে দখল হওয়া বিভিন্ন এলাকা উদ্ধারও করেছিলেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। বিশেষ করে মার্কিন মধ্যস্থতায় হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসায়েলের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই হুট করে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার বিভিন্ন শহর দখলে নিতে শুরু করেন। আলেপ্পোর দখল দিয়ে কোণঠাসা হওয়া বিদ্রোহীদের পুনর্যাত্রা শুরু হয়। এরপর হামা, হোম, দামেস্ক দখল করে নেন কার্যত কোনো বাধা ছাড়াই।

বাশার আল–আসাদ পালিয়ে যাওয়ায় সিরিয়ায় শুধু বাথ পার্টির শাসনেরই অবসান ঘটেনি, একই সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধে ইরান ও রাশিয়ারও পরাজয় ঘটেছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরান ও রাশিয়ার সহায়তা নিয়েই বাশার ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। বাশারকে সহায়তা করার মাধ্যমে ইরান কার্যত ইসরায়েল সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। রাশিয়ার যোদ্ধা ও যুদ্ধজাহাজ সিরিয়ার অবস্থান নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছিল। কিন্তু বাশারের পতনের পর ওই অঞ্চলে ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব কমে আসবে, যা ইসরায়েলের জন্য স্বস্তির সংবাদ হতে পারে।

সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি ইসরায়েলে জন্য অস্বস্তির বিষয় ছিল। ইরানি মিলিশিয়ারা শুধু বিদ্রোহীদেরই দমন করেনি, একই সঙ্গে লেবাবনের হিজবুল্লাহদেরও সহায়তা করত। ইরান থেকে লেবাননে হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ার মিলিশিয়াদের সামরিক সরবরাহের মূল পাইপলাইন ছিল সিরিয়া। বাশারের পতন ঘটিয়ে ইসরায়েল সফলভাবে হিজবুল্লাহর সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

জোলানির তাহরির আল–শামের সর্বশেষ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সিরিয়া থেকে ইরানের সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়ন করা। ইসরায়েলেরও লক্ষ্য ছিল সিরিয়া থেকে ইরানকে বিতারণ করা। ভবিষ্যতে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সিরিয়ার যুদ্ধে ইসরায়েল, মার্কিন ও তাহরির আল–শামের লক্ষ্য যে এক ছিল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তাদের মধ্যে কৌশলগত পারস্পরিক সমঝোতা ও সহায়তা থাকতেই পারে। তাই বাশারকে হটাতে তাহরির আল–শামকে ইসরায়েলের অঘোষিত সহায়তা দিনের মতোই স্পষ্ট।

সিরিয়া যুদ্ধে বিদ্রোহীদের দমনের অন্যতম রূপকার ছিলেন ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তিনিই মূলত রাশিয়াকে সিরিয়া যুদ্ধে সম্পৃক্ত করেন। ইসরায়েলের পরামর্শেই যুক্তরাষ্ট্র কাশেম সোলাইমানিকে ইরাকে হত্যা করে। না হলে পুরো সিরিয়াই ইরান ও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ধারাবাহিকভাবে সিরিয়ায় হামলা করে ইসরায়েল ইরানি সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করতে থাকে। ইসরায়েল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটও হামলা করে গুঁড়িয়ে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করে।

ইরানে হামলা করে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে। সম্প্রতি হিবজুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ও তার উত্তরসূরি হাশেম সাফিউদ্দিনকে হত্যা করে। গাজায় হামলা করে হামাস নেতা ইয়াহহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে। বিগত সময়ে ইসরায়েল ইরান ও ইরানপন্থী প্রথম সারির সব সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। এতে নিশ্চিতভাবেই সিরিয়ায় ইরানের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। ফলে ইসরায়েলি হামলার মুখে সিরিয়া থেকে ইরানের মিলিশিয়ারা পিছু হটতে শুরু করে।

অপর দিকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াও সিরিয়া থেকে তার যোদ্ধাদের সরিয়ে নিতে শুরু করে। ইউক্রেনে অধিক মনোযোগ দেওয়ার কারণে রাশিয়ার পক্ষে অব্যাহতভাবে বাশার আল–আসাদকে সমর্থন করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাশারের প্রতি রাশিয়ার সামরিক সহায়তা কমে আসতে শুরু করে।

এর পাশাপাশি হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধ শুরু হওয়ার থেকে নিয়মিত সিরিয়ায় বাশার–সমর্থিত সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করেছে ইসরায়েল। কার্যত ইসরায়েলের হামলার কারণে দুর্বল হওয়া বাশারের বাহিনী ইরান ও রাশিয়ার পর্যাপ্ত সহায়তা না পেয়ে বিদ্রোহীদের হামলার মুখে আর টিকতে পারেনি।

এর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল সিরিয়া সরকারের আর্থিক সংকট। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক নিষেধাজ্ঞার কারণে চরম আর্থিক সংকটে ছিলেন বাশার আল–আসাদ। এমনকি শেষ দিকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বেতনও দিতে পারছিলেন না। আর্থিক সংকট এবং রাশিয়া, ইরানের যোদ্ধারা পিছু হটায় বাশার বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। যে কারণে বিদ্রোহীদের হামলার মুখে বাশার বাহিনী কোনো ধরনের প্রতিরোধ না করে নিজেরাও পালিয়ে ইরাকে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করে, যা বাশারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।

মূলত সিরিয়ায় ক্রমাগত ইসরালেয়ের বিমান হামলা বিদ্রোহীদের পথ সহজ করে দেয়। আল–জাজিরার হিসাবমতে, সিরিয়ায় বাশারের অনুগত বাহিনী ও ইরানের মিলিশিয়াদের ওপর ইসরায়েল প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনবার করে হামলা করেছে।

আকাশপথে ইসরায়েলের হামলা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের স্থলপথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পরিষ্কার করে দেয়। ইসরায়েল জানত, তাদের হামলার মুখে বাশারের বাহিনী ও ইরানের মিলিশিয়ারা পিছু হটলে বিদ্রোহীরা সিরিয়া দখল করবেন। কিন্তু ইসরায়েলের কাছে এই মুহূর্তে বিদ্রোহীদের থেকে বাশার আল–আসাদ ও সিরিয়ার ইরানি মিলিশিয়াদের উপস্থিতি বেশি ঝুঁকির কারণ ছিল। আর সিরিয়া ইরানবিরোধীদের হাতে গেলে হিজবুল্লাহ ও হামাসের সামরিক সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এতে হিজবুল্লাহ ও হামাস দুর্বল হয়ে যাবে। আর ইতিপূর্বে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার বিদ্রোহী বা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখা যায়নি; বরং সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদীদের ইসরায়েল চিকিৎসা প্রদানসহ নানাভাবে সহায়তা করেছে।

তাই এই মুহূর্তে সিরিয়ায় বাশারের পতনই ইসরায়েলের জন্য অধিকতর নিরাপদ পন্থা ছিল। ইসরায়েল ঠিক তা–ই করেছে। আকাশপথে হামলা করে বিদ্রোহীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এটা ছিল সিরিয়ায় ইরানকে হারিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে সহজ রাস্তা ইসরায়েলের জন্য। উল্লেখ্য, বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখলের পরপরই ইসরায়েলি ট্যাংক সীমানা অতিক্রম করে গোলান মালভূমিতে প্রবেশ করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গে কি ইরানের সম্পর্ক হতে পারে না। আপাতত না। কারণ, তাহরির আল–শামের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সিরিয়া থেকে ইরানিদের বের করে দেওয়া। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা মূলত সুন্নি সালাফিস্ট। এদের সঙ্গে ইরানি শিয়াদের কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন এক দুরূহ বিষয়। কোনো কারণে ভবিষ্যতে সম্পর্ক হলেও তা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সুবিধা হচ্ছে, সিরিয়া হয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনে হামাসের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। আবার কেউ যদি সিরিয়া দখল করে নেওয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সহায়তা করে, তবে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসবাদবিরোধী দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু করা যাবে। ইসরায়েল আগেভাগেই বলে রেখেছে, সিরিয়া আল–কায়েদা দখল করে নিয়েছে এবং নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। যদিও তাহরির আল–শামের নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি ২০১৬ সালে আল–কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

এদিকে সিরিয়ার সুন্নি সালাফিস্টরা বাশার আল–আসাদের পতনে উল্লাস করেছেন। বাশার আল–আসাদ মূলত সিরিয়ার সংখ্যালঘু আলাওতি সম্প্রদায় থেকে আসা। ফলে সিরিয়ার বিপুলসংখ্যক সুন্নির সঙ্গে বাশার আল–আসাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পার্থক্য আছে। এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে সুন্নিদের বিশ্বাসগত ব্যবধান রয়েছে।

আলাওতিরা ইসলামের পাশাপাশি খ্রিষ্টান ও জরথুস্ত্রদেরও কিছু কিছু ধর্মীয় ঐতিহ্য পালন করে থাকে। ধর্মীয় পার্থক্য ছাড়াও বাশার আল–আসাদ গণতান্ত্রিক শাসক ছিলেন না। বিরোধী মত নির্মমভাবে দমন করেছেন। বাবা হাফিজ আল–আসাদের মতোই নিজেকে কঠোর একনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে বিপুলসংখ্যক সিরিয়ার নাগরিকের কাছে তিনি কখনোই জনপ্রিয় ছিলেন না। ভয়ংকর এক শাসনের সূচনা করেছিলেন বাশারের বাবা হাফিজ। বাশার সেই একদলীয় শাসনের কঠোরতা ধরে রেখেছিলেন। ফলে তাঁর পতনে সিরিয়ার উল্লাস হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাশার আল–আসাদের পতন কোনো গণতান্ত্রিক শক্তির হাতে হয়নি; বরং এমন একটি শক্তির হাতে পতন হয়েছে, যাদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আইএস, আইসিস, নুসরা ফ্রন্ট, আল–কায়েদার মতো সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনের সম্পর্ক ছিল।

দামেস্ক দখল করা সশস্ত্র সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শামের নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি দীর্ঘ সময় মার্কিন জেলে ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি মার্কিন সেনাদের হাতে আটক হন। ২০১১ সালে সিরিয়ায় বাশারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলে বাশার নির্মমভাবে দমন শুরু করেন। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ চলাকালেই জোলানি জেল থেকে বেরিয়ে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন।

জোলানির তাহরির আল–শামের সর্বশেষ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সিরিয়া থেকে ইরানের সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়ন করা। ইসরায়েলেরও লক্ষ্য ছিল সিরিয়া থেকে ইরানকে বিতারণ করা। ভবিষ্যতে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সিরিয়ার যুদ্ধে ইসরায়েল, মার্কিন ও তাহরির আল–শামের লক্ষ্য যে এক ছিল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তাদের মধ্যে কৌশলগত পারস্পরিক সমঝোতা ও সহায়তা থাকতেই পারে। তাই বাশারকে হটাতে তাহরির আল–শামকে ইসরায়েলের অঘোষিত সহায়তা দিনের মতোই স্পষ্ট।

  • ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক