বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন কি পারবে

গত দুই মাসের বেশি সময় যাবৎ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। ক্লাস-পরীক্ষা কোনো কিছুই হচ্ছে না। এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে একটি ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান। মূলত গত ১ জুলাই থেকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ। একই সময়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের পৃথক দুটি আন্দোলন চলছিল। তবে কর্মসূচি ছিল অভিন্ন, ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ।  সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১ জুলাই থেকে বিশ্বদ্যিালয়গুলোতে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়।

অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রত্যয় পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে ১ জুলাই থেকে কর্মবিরতি শুরু করে। ফলে খুব দ্রুতই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও নতুন গতি পায়। গত ৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী এক ছাত্র–জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে গত দেড় যুগ বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা পদত্যাগ করেন।

কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজন পদত্যাগে বাধ্য হন। এই পদগুলোতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাই বিগত সরকারের আদর্শের লোক। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেবারই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গত এক মাস যাবৎ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে অভিভাবকশূন্য অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। কারণ, দুই মাস যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। প্রশাসক নিয়োগ করে, নতুন করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে আরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালযগুলো প্রায় ছয় মাসের সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে।

দুই.

নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারা উপাচার্য, সহ–উপাচার্য  হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, এ নিয়ে চলছিল নানা জল্পনাকল্পনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বড় একটি অংশ সাদা এবং নীল দলে বিভক্ত। সাদা দল বলতে বোঝানো হয় বিএনপি–জামায়াত সমর্থিত শিক্ষক সমাজ এবং নীল দল বলতে আওয়ামী লীগ এবং সমমনা সমর্থিত শিক্ষক। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তাই এমন একটি ভাবনা অনেকের মধ্যে ছিল যে বিকল্প হিসেবে সাদা দল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। সাধারণত দলের মধ্যে যাঁরা  সিনিয়র এবং দলের জন্য অবদান বেশি, তাঁরাই এসব পদে দলীয় বিবেচনায় পেয়ে থাকেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যুগ যুগ ধরে সাদা ও নীলের এই ধারা বহমান। তাই কয়েক সপ্তাহ যাবৎ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি–প্রোভিসি হওয়ার জন্য অনেক শিক্ষক দৌড়াদড়ি শুরু করেছেন। কে কার চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন, এটি প্রমাণের জোর প্রচেষ্টাও অব্যাহত ছিল।

এই মুহূর্তে এটি দেখানোর সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হলো সোশ্যাল মিডিয়া। এ নিয়ে আবার  বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছিল , বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। ফলে একধরনের শিক্ষক যাঁরা উপাচার্য ও সহ–উপাচার্য হতে চান, তাঁদের অনেকেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেছনে ছোটা ছুটি করতে শুরু করেন। একই সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো বিবৃতিযুদ্ধে মেতেছে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকেরা।

এ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো গত ২৪ আগস্ট ‘উপাচার্য নিয়োগ: চবিতে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষকদের একটি অংশ মানববন্ধন করে বলেছে, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে থেকে যেন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি না হলে তারা মানবে না।

ময়মনসিংহে অবস্থিত  জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, উপাচার্য হিসেবে যেন সেখানে সেনাবাহিনীর পদস্থ একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হোক। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য দলীয় শিক্ষকের বাইরে সেনাবাহিনীর একজনকে নিয়োগ দিলে তিনি ভালোভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারবেন।

পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের এক সিনিয়র এক শিক্ষকের পুত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, শোনা যাচ্ছে তাঁর বাবা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেন। ছেলের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর বাবা মোটেই দলনিরপেক্ষ নন। ছেলে চান না তাঁর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে আসুক। এ দিয়ে উপলব্ধি করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দারুণ ব্যস্ত উপাচার্য, সহ–উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপাচার্য নিয়োগে দুই দিনের আলটিমেটামও দিয়েছেন ইতিমধ্যে।

এই সময়ে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। কারণ, দুই মাস যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। প্রশাসক নিয়োগ করে, নতুন করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে আরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালযগুলো প্রায় ছয় মাসের সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নবাগত শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়নি। এরই মধ্যে দেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘিরে, বিশেষ করে ছাত্র-জনতার ওপর সরকারি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের যে নির্যাতন, ছাত্র–শিক্ষকেরা এসব নিয়ে রয়েছেন একধরনের ‘মানসিক ট্রমা’র মধ্যে। এ অবস্থায় ছাত্র-শিক্ষকেরা একাডেমিক কার্যক্রমে কতটুকু মনোনিবেশ করতে পারবে, সেটিও যথেষ্ট ভাবনার বিষয়।

তিন.

ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পাশাপাশি সহ-উপাচার্য পদেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মারফতে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক অঙ্গনে যথেষ্ট সরব। এর মধ্যে তিনজন বিশ্বসেরা অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে তাঁদের নিয়োগ হয়নি। দু-একজন বাদে একাডেমিকের বাইরে তাঁদের সেই ধরনের কোনো পরিচিতিও নেই। অনেকে বয়সেও অনেক তরুণ।

মূলত একাডেমিক প্রোফাইল দেখেই তাঁদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই নিয়োগের মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, যুগের পর যুগ ধরে যখন যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, তাদের ‘আদর্শের’ এবং ‘অনুগত’ শিক্ষকেরা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়, সেই সংস্কৃতি থেকে কিছুটা হলেও বের হওয়া সম্ভব হয়েছে। এটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের একটি বড় সার্থকতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য ইতিমধ্যে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গণরুমের নিপীড়নের সংস্কৃতি থাকবে না’, ছাত্রদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতে চান তিনি। নতুন উপাচার্য আরও বলেছেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়। এটা সবার বিশ্ববিদ্যালয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্যের কথা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক ও ছাত্রবান্ধব। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম এবং গণরুম কালচার কোনো শিক্ষার্থীই পছন্দ করেন না। শিক্ষার্থীরা চান বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরে আসুক, একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হোক,আবাসিক হলগুলোতে মেধার মাধ্যমে আসন বণ্টন হোক, ছাত্র সংসদ চালু হোক, শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সব জায়গায় মেধা এবং যোগ্যতা গুরুত্ব পাক। ভয়হীনভাবে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মত প্রকাশ করতে চান, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে চান।

অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতার বিপ্লব তখনই সার্থক হবে, যদি ন্যায্যতার মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হয়। তবে এটি সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা এখন আগের চেয়ে অনেক কঠিন হবে। কারণ দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যেভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল, এখন কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে বলে আশা করা যায়। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে যাঁরা নিয়োগ পাবেন, তাঁদের একাডেমিক দক্ষতার পাশাপাশি বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন। কারণ নতুন এই সময়ে তাঁদের অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হবে।

  • মো. সাহাবুল হক অধ্যাপক, রাজনৈতিক অধ্যায়ন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট