মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বৃহস্পতিবার রাতে কংগ্রেসে স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণ দিয়েছেন। তিনি যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন আমেরিকানদের পাশাপাশি আমেরিকান নির্বাচনের বিষয়ে ক্রমে নার্ভাস হয়ে পড়তে থাকা বিশ্ব ‘স্টেট অব ইউনিয়ন (‘ইউনিয়নের অবস্থা’ অর্থে)-এর বদলে ‘স্টেট অব জো বাইডেন’ (বাইডেনের অবস্থা)–কে মূল্যায়নের বিষয়ে বেশি মনোযোগী ছিল।
আমি ‘স্টেট অব বাইডেন’ বলতে বাইডেনের রাজনৈতিক অবস্থার কথা বলছি না, বরং আমি তাঁর ‘শারীরিক দশার’ কথা বোঝাতে চাইছি।
নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর এটি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে আগামী নভেম্বরে ২০২০ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ এবারও সেই বাইডেন ও সেই ট্রাম্পের মধ্যে লড়াই হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাইডেনের বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে ট্রাম্পের খোঁচা দেওয়া বক্তৃতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া হাজার হাজার মিমের কারণে বাইডেন বয়সের ভারে কথাবার্তায় খেই হারিয়ে ফেলা ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা ব্যক্তি হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তৃতা এবং সেসব মিমের ভাষ্য যে ঠিক নয়, তা বাইডেনকেই প্রমাণ করতে হবে।
৬৪ মিনিটের বেশ লড়াকু বক্তব্যে বাইডেন সেই বাধা বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছেন। ভাষণে তিনি বেশ চড়া স্বরে বিরোধীদের আক্রমণ করেছেন। তিনি রিপাবলিকান শিবিরকে কথার তিরে বিদ্ধ করেছেন। এর আগে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাইডেন জীবিত ও মৃত ব্যক্তিকে গুলিয়ে ফেলায় ফক্স নিউজ তাঁকে টলটলায়মান মাতাল ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছিল এবং তারা তাঁকে ‘জ্যান্ত লাশ’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছিল।
তবে স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণটি সে ধরনের ‘সিনিয়র মোমেন্টস’ (‘বার্ধক্যজনিত খেই হারানো কথা বা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া) থেকে মুক্ত থাকায় ইতিমধ্যে পণ্ডিতেরা বাইডেনের ভাষণকে ‘সাহসী’ এবং ‘অসাধারণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
গণমাধ্যমে জো বাইডেনকে সাহসী হিসেবে দেখানোটা ডেমোক্র্যাটদের জন্য খুব জরুরি ছিল। কারণ, আগামী আট মাস তাঁকে যে খাড়া পাহাড়ে উঠতে হবে, সেই পথে চড়াই–উতরাই বাড়তেই থাকবে। চলতি সপ্তাহেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ট্রাম্প কেবল তাঁর সমর্থকদের মনোনীত প্রার্থী নন।
তিনি সুপার টুয়েসডের প্রাইমারিতে তাঁর সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী নিকি হ্যালিকে একটি ছাড়া সব ক্ষেত্রেই পরাস্ত করেছেন এবং হ্যালিকে নির্বাচনী দৌড় থেকে বের করে দিয়েছেন। রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে পুরো পরিস্থিতি এখন বাইডেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কংগ্রেসে রিপাবলিকান নেতাদের মধ্যে যাঁরা একসময় ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন, তাঁরাও এখন ট্রাম্পের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদায়ী রিপাবলিকান সিনেটর মিচ ম্যাককোনেলের তাইওয়ান বংশোদ্ভূত স্ত্রীকে নিয়ে ট্রাম্প চরম বর্ণবাদী মন্তব্য করার জের ধরে ট্রাম্পের সঙ্গে ম্যাককোনেলের তিন বছর ধরে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। সেই ম্যাককোনেলও ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন।
সীমান্ত চুক্তি নিয়ে রিপাবলিকান দলের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের একটি আপসরফাভিত্তিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। রিপাবলিকান নেতারা সেই চুক্তির প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন। এর কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে অভিবাসন ইস্যুতে বাইডেনকে আক্রমণ করতে পারবেন।
অনেকে আশা করেছিলেন, প্রাইমারির মৌসুমে রিপাবলিকানদের মধ্যে থাকা ট্রাম্পবিরোধীরা একটি বড় ভূমিকা রাখবেন এবং প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান তাঁরা দুর্বল করে দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই তত্ত্ব আর কাজ করেনি। শুধু তা–ই নয়, অনেকে আশা করেছিলেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে ৯১টি বিস্ময়কর ফৌজদারি অভিযোগে মামলাগুলো হয়েছিল, সেই মামলাগুলো আদালতে উঠবে এবং মামলাগুলো তাঁকে দুর্বল করে ফেলবে।
কলোরাডোর (এবং অন্য দুটি অঙ্গরাজ্য) বিচারকেরা ট্রাম্পকে এক রায়ে ব্যালট থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা রায় দিয়েছিলেন, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে যে হামলার ঘটনা ঘটেছিল, সেটি স্পষ্টই ট্রাম্পকে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য প্রতিপন্ন করেছে। কিন্তু গত সোমবার সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে কলোরাডোর আদালতের দেওয়া রায় খারিজ করে দেন এবং ৫০টি অঙ্গরাজ্যেই ট্রাম্প দাঁড়াতে পারবেন বলে চূড়ান্ত ঘোষণা দেন।
ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার আগে সুপ্রিম কোর্টে তিনজন চরম ডানপন্থী বিচারক নিয়োগ করে গিয়েছিলেন। সেই নিয়োগের বদৌলতে সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পপন্থী বিচারকদের প্রাধান্য রয়েছে। সেই আদালত সম্প্রতি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগে করা মামলাটির কার্যক্রমকে কার্যকরভাবে ধীরগতির করে দিয়েছেন।
মামলাটি ছিল ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল ট্রাম্প উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই মামলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনের আগে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে, এমন আশা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এই উপলব্ধি ডেমোক্র্যাট শিবিরকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে।
গত মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মস্কোর মধ্যে একধরনের আঁতাত তৈরি হয়েছিল বলে স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলারের তদন্তে তথ্য উঠে আসার পর থেকে ডেমোক্র্যাটরা আশা করে এসেছেন, বিচারিক কর্তৃপক্ষ আমেরিকার ‘ট্রাম্প সমস্যা’র সমাধান করে দেবে।
তবে বারবার ডেমোক্র্যাটদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। ডেমোক্র্যাটরা এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। যদি তাঁরা ট্রাম্পকে পরাজিত করতে চান, তাহলে তাঁদের অবশ্যই সেটা করতে হবে, যা তাঁরা ২০২০ সালে করেছিলেন। অর্থাৎ ভোট দিয়ে তাঁদের ট্রাম্পকে পরাজিত করতে হবে।
সেই কাজটি এখন ডেমোক্র্যাটদের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। জাতীয় সংবাদমাধ্যমের শিরোনামেই শুধু ট্রাম্প এগিয়ে থাকছেন না। বরং তিনি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, এমন বিভিন্ন রাজ্যে জনপ্রিয়তায় বেশ এগিয়ে গেছেন। গত নির্বাচনে বাইডেনের জয়ের পেছনে যে ভোটিং গ্রুপগুলো নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, সেই গ্রুপগুলোর মধ্যেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক ভোটারদের ভেতরেও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছে।
বাইডেন এখনো ট্রাম্পের চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকলেও বাইডেন জনপ্রিয়তার যে বিশাল ব্যবধান গতবার উপভোগ করেছিলেন, সেই জনপ্রিয়তা এখন আর তাঁর নেই। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ যে ভোটাররা গতবার ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁদের সেই সমর্থনের জায়গা থেকে সরে আসেননি। ডেমোক্র্যাটদের জন্য সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার কথা হচ্ছে, তরুণ ভোটারদের অনেকেই পক্ষত্যাগ করছেন। ২০২০ সালের ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটারদের মধ্যে ২৫ পয়েন্ট পেয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু এবার সেই সংখ্যা প্রায় সমান সমান হয়ে এসেছে।
গাজা থেকে প্রতিদিন ভয়ংকর সব চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। এরপরও ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের সমর্থন তরুণ ভোটারদের উত্তরোত্তর বিক্ষুব্ধ করছে। বিশেষ করে মিশিগানের মতো আরব আমেরিকান সুইং ভোটার অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যগুলোতে বাইডেনের জনসমর্থন অনেক কমে গেছে।
এসব দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, এবার ট্রাম্পকে হারানো বাইডেনের জন্য গতবারের চেয়ে অনেক কঠিন হবে।
● জনাথন ফ্রিডল্যান্ড দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত