মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়কে বিনোদনকেন্দ্র বানানোর প্রকল্প ও রুবিনার মৃত্যু নিয়ে যে প্রশ্ন

দুর্ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে প্রতিবাদ করেন। বড় আন্দোলন হলে কর্তৃপক্ষ কিছুদিনের জন্য নড়েচড়ে বসেন। তারপর আবার যা, তা-ই।
ছবি : প্রথম আলো

শত শত মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, রিকশা; হরেক রকম খাবারের দোকান, ফুটপাত, সড়ক কিংবা খোলা চত্বর—কোথাও তিলধারণের ঠাঁই নেই। হাজার হাজার মানুষের স্রোত। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, কোনো এক জনাকীর্ণ মেলার মাঠ। না, মেলা নয়, ছুটির দিনগুলোয় এ চিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। টিএসসি, সড়কদ্বীপ, রাজু ভাস্কর্য, হাকিম চত্বর, লাইব্রেরি চত্বর, ডাকসু থেকে অপরাজেয় বাংলা হয়ে মলচত্বর—পুরো এলাকায় কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বিদ্রূপমেশানো ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ঢাকার বৃহত্তম বিনোদনকেন্দ্র। কেউ কেউ আবার ‘বহিরাগত’মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথাও বলেন।

২ ডিসেম্বর এ রকমই এক ছুটির দিন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাক্ষী হয়ে থাকল সাম্প্রতিককালের অন্যতম অমানবিক এক ঘটনার। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির উল্টো দিকে সড়কে মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় বেপরোয়াভাবে চালিয়ে আসা একটি প্রাইভেট কার। মোটরসাইকেলের পেছনে বসা রুবিনা আক্তার নামের এক নারী সড়কে পড়ে গেলে প্রাইভেট কারের বাম্পারে আটকে যায় তাঁর পোশাক। প্রাইভেট কারটি না থেমে এ অবস্থায় এক কিলোমিটারের বেশি পথ পেরিয়ে যায়। পথচারীরা গাড়িচালককে থামতে অনুরোধ করলেও তিনি না থামিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান। কয়েকটি মোটরসাইকেল পিছু ধাওয়া করে নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণের কাছে গাড়িটির গতি রোধ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বলেছেন, দুর্ঘটনার পর হামলা কিংবা গণপিটুনির শঙ্কায় চালক গাড়ি না থামিয়ে এমন আচরণ করে থাকতে পারেন। শেষ পর্যন্ত উত্তেজিত জনতার মারধরের শিকার যেমন হয়েছেন, আবার তাঁর গাড়ি ভাঙচুরও করা হয়েছে। চালকের এই ঊনমানুষের মতো আচরণে প্রাণ হারিয়েছেন রুবিনা। তিন বছর আগে স্বামী মারা যাওয়া রুবিনা ১৪ বছরের সন্তান আরাফাতকে আঁকড়ে যে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনেছিলেন, তার করুণ পরিসমাপ্তি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাস হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। এটা অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। ফলে জনপরিসর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র অবস্থান থাকাটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন অংশের বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানগত, সংস্কৃতিগত অথবা রাজনৈতিক সংযোগ ও আদান-প্রদান স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু একাডেমি বা বিদ্যায়তন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির মর্যাদা আর গাম্ভীর্য তো থাকতে হবে।

গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহ। একাডেমিক দায়িত্বে অবহেলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে কয়েক বছর আগে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তাঁর সাবেক সহকর্মীদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, শিক্ষকতা করার চেয়ে পেশিশক্তি প্রদর্শন করতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি।

প্রাইভেট কারের বাম্পারে আটকে পড়া রুবিনাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ক্ষোভের জন্ম হয়। যদিও বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছোট্ট একটি অংশ নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভে নেমে পড়েন। ওই দিন রাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম পর্বে ব্রাজিলের খেলা ছিল। এবার বিশ্বকাপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি জায়গায় বড় পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের খেলার দিনে বিশ্ববিদ্যালয় লোকারণ্য হয়ে ওঠে। শুধু বর্তমান শিক্ষার্থী নয়, প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনেকেই একসঙ্গে খেলা দেখার আনন্দ ভাগাভাগি করতে এখানে আসেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, এ রকম কিশোর-তরুণ থেকে নানা বয়সী মানুষ এখানে সমবেত হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ অন্তত সেদিনের জন্য বড় পর্দায় খেলা দেখানো বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী তারেক হাসান নির্ঝর ফেসবুকে লেখেন, ‘রক্তের দাগ লেগে আছে ক্যাম্পাসের পথে। শুকিয়ে ধুলো হয়ে বাতাসে রক্তকণা মিশে যেতে হয়তো আরও একটি-দুটি দিন সময় লাগব। অন্যদিকে আজ রাতে ব্রাজিলের ম্যাচ। স্বাভাবিকভাবেই হাজার হাজার মানুষ ক্যাম্পাসে আসবে, ব্রাজিলের ম্যাচে উৎসব করবে। এমন পরিস্থিতিতে মুহসীন হলের মাঠ ও টিএসসির বড় পর্দায় আজকের ম্যাচটি না দেখালেই শ্রেয়তর হয়।’

কোনো দুর্ঘটনা, প্রাণহানি কিংবা বিপুল জনগোষ্ঠীকে নাড়া দেওয়ার শোকে সামাজিক সংহতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আচরণ। এ ধরনের কোনো ঘটনায় মানবীয় যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। কিন্তু সামাজিক সংহতি মানে হলো, শোকার্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, তারা যে একা নয়, সেই অনুভূতি তাদের ভেতর সঞ্চার করে দেওয়া। ভবিষ্যতে যাতে আবার এ ধরনের ট্র্যাজেডি না ঘটে, তার জন্য সামাজিক অঙ্গীকারের ব্যাপারও এখানে রয়েছে। কিন্তু সমব্যথা, দয়া—এসব অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের সমাজ পেছন পায়ে হাঁটছে। আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে সংহতি প্রকাশের সংস্কৃতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে বেছে বেছে দু-একটি ঘটনা ছাড়া সংহতি প্রকাশের নজির আমরা দেখি না। সবকিছু ঠিকঠাক আছে, কোথাও কোনো গড়বড় নেই, বরং যে যার মতো মগ্ন থাক—এমন একটা ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। ফলে সে রাতে বড় পর্দায় খেলা চলেছে। যে এক কিলোমিটারের বেশি পথ ধরে রুবিনার শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে সড়কের কালো পিচে মিশেছে, সেই সড়ক ধরেই ভুভুজেলার বিকট আওয়াজ তুলে মানুষেরা ফিরেছে। কোথাও কোনো বিকার কিন্তু দেখা যায়নি।

যে পথ ধরে রুবিনার শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে সড়কের কালো পিচে মিশেছে, সেই সড়ক ধরেই ভুভুজেলার বিকট আওয়াজ তুলে মানুষেরা ফিরেছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাস হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। এটা অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। ফলে জনপরিসর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র অবস্থান থাকাটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন অংশের বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানগত, সংস্কৃতিগত অথবা রাজনৈতিক সংযোগ ও আদান-প্রদান স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু একাডেমি বা বিদ্যায়তন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির মর্যাদা আর গাম্ভীর্য তো থাকতে হবে। একজন শিক্ষার্থী, একজন শিক্ষকের পড়াশোনা, গবেষণা কিংবা একাডেমিক কোনো কাজ যদি বাধাগ্রস্ত হয়, সে ধরনের কোনো আয়োজনে প্রশ্ন উঠবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে মেলা, হাটবাজার কিংবা বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা সেখানে রীতিমতো অপরাধ।

প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের নগর এখন ঢাকা। মিরপুর কিংবা মোহাম্মদপুরের কথা চিন্তা করুন। এসব এলাকায় যত মানুষ বাস করে, এবারের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ কাতারের মোট জনসংখ্যা তার চেয়ে কম। পুরো অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের একচ্ছত্র কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলায় এখানে মানুষ বাড়ছে রকেটের গতিতে। ফলে বাসযোগ্যতার সব সূচকের পেছনের দিক থেকে একেবারে সামনের কাতারে ঢাকা। দেশের জনমিতিক যে অবস্থা, তাতে ঢাকার জনসংখ্যারও সবচেয়ে বড় অংশ ২০-৩৫ বছরের নিচের জনগোষ্ঠী। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের কথা বলার জন্য, আড্ডা দেওয়ার, সমবেত হওয়ার জন্য অসংখ্য জনপরিসর থাকা প্রয়োজন।

ঢাকায় যেসব জনপরিসর ছিল, সেগুলোও এখন হয় বন্ধ, নয়তো সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই আজিজ সুপার মার্কেট। বইয়ের দোকানের পাশাপাশি একসময় ঢাকার লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আড্ডার স্থান ছিল। এখন সেখানে সারি সারি কাপড়ের দোকান। বছর কয়েক আগেও চারুকলার সামনে ছবির হাটকেন্দ্রিক একটা আড্ডা জমত। সেটাও এখন নিরাপত্তার অজুহাতে বন্ধ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিশাল পরিসর থাকলেও সেখানে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় নিরাপদ বোধ করেন না কেউ। রমনা পার্কে সান্ধ্য আইন বলবৎ। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি মাঠ আধুনিকায়নের নামে এখন হয় বন্ধ। উন্নয়ন করে যেগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটি রক্ষণাবেক্ষণের নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। অনেকেই সেখানে যেতে চান না। ফলে সবারই গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থীদের ভাষায় ‘বৃহত্তম বিনোদনকেন্দ্র’।

দুর্ঘটনা ঘটলে  শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে প্রতিবাদ করেন। বড় আন্দোলন হলে কর্তৃপক্ষ কিছুদিনের জন্য নড়েচড়ে বসেন। তারপর আবার যা, তা-ই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ রাখার, সেখানে সুস্থ পরিবেশ বজায় রখার দায়িত্ব আসলে কাদের? ঢাকায় মানুষ আর যানবাহনের তুলনায় সড়কের যে অপ্রতুলতা, তাতে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সড়কে একেবারে যান চলাচল বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই সড়ক ধরে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করবে, গতিসীমা কত হবে, তার সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জনপরিসরকে ‘বৃহত্তম বিনোদনকেন্দ্র’ বানানো  চিন্তার দিক থেকে সুস্থতার লক্ষণ নয়। রুবিনার মর্মিন্তিক মৃত্যু সেই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক