শিক্ষক প্রশিক্ষণে কাজ হয় না কেন

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের তোড়জোড় চলছে। যদিও অবস্থা দেখে মনে হয়, আগামী দু-চার মাসের মধ্যে এ প্রশিক্ষণের কাজ শেষ হবে না। এ ছাড়া সব শিক্ষককে এ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব নয়। এর বিকল্প ভালো সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়ে কেউ ভাবছেও না। এদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষের এক মাসের বেশি সময় পার হয়েছে। অধিকাংশ স্কুলে নতুন শিক্ষাক্রমের ক্লাস শুরু করা যায়নি। যেসব স্কুল নিজেদের মতো করে শুরু করেছে, তারাও আসলে ঠিক করছে না। কারণ, গতানুগতিক ধারার পাঠদান প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষকদের বের করে আনা নতুন শিক্ষাক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য। এ জন্য বিশেষভাবে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়েছে। এমনকি মূল্যায়ন বা পরীক্ষাপদ্ধতিতেও এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। এগুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে ক্লাস শুরু করলে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

অভিজ্ঞতাভিত্তিক যে পাঠদান ও মূল্যায়নপদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, তা পৃথিবীর মাত্র ১০-১৫টি দেশে চালু আছে। নতুন এ ধারণা দু-চার দিনের কর্মশালা করে শেখানো যাবে না। এর প্রমাণ, শিক্ষাক্রম প্রণয়নের শুরু থেকে যুক্ত থাকা এনসিটিবির বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনো এ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া বুঝে উঠতে পারেননি। এ ছাড়া এই শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে কেন ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ বলা হচ্ছে, তা মাস্টার ট্রেইনাররাও ঠিকঠাক বলতে পারবেন না। তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে যে পর্বতসমান আয়োজন চলছে, তাতে মূষিক প্রসব ছাড়া আর কোনো ফল পাওয়ার আশা করা যায় না। এতে শুধু সময় আর অর্থেরই অপচয় হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, দুই দিন বা চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকেরা আসলে কতটুকু শিখতে পারেন কিংবা কতটুকুই আর তাঁদের শেখানো যায়! তাই এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য সময় আর অর্থ ব্যয়ের প্রকল্প থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’ আসলেই যদি কার্যকর করতে হয়, তবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পরপরই তাঁদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য দেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও কলেজগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। অন্তত ছয় মাসের সুনির্দিষ্ট সিলেবাসভিত্তিক কোর্স করিয়ে তাঁদের শ্রেণিকক্ষে পাঠানো উচিত।

প্রাথমিকের দিকে তাকান। ২ কোটি ২০ লাখের মতো শিক্ষার্থী আছে প্রাথমিক পর্যায়ে। শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ২২ হাজারের বেশি। এবার যদিও কেবল প্রথম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে, তবে সব শিক্ষককেই প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। এনসিটিবির সহায়তায় ডিপিই প্রথমে ৫০ জন কোর-ট্রেইনার তৈরি করবে। এই কোর-ট্রেইনাররা তৈরি করবেন ২০০ জন কি-ট্রেইনার। কি-ট্রেইনার থেকে তৈরি হবে ১ হাজার ৬০০ মাস্টার ট্রেইনার। মাস্টার ট্রেইনাররা জেলা পর্যায়ের ট্রেইনার তৈরি করবেন। জেলা পর্যায়ের ট্রেইনাররা বিভিন্ন স্কুলশিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। বোঝাই যাচ্ছে, এটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এ ছাড়া কোর-ট্রেইনার থেকে শ্রেণিশিক্ষক পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে গিয়ে প্রশিক্ষণের সারবস্তুর খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে।

অন্যদিকে মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। মাধ্যমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তর (মাউশি)। এখানেও মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রশিক্ষণ পৌঁছাতে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হবে। ফলে বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণের কতটুকু প্রয়োগ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সন্দেহের কথা বলতেই হচ্ছে। কারণ, গত বছর ৫০টি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। তখন ওই সব স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখেছি, চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে তাঁরা আসলে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। কোর-ট্রেইনারদের কাছ থেকে সরাসরি ট্রেনিং পেয়েও তাঁরা ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না। প্রশিক্ষণকালে তাঁদের যখন নমুনা ক্লাস নিতে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা শুধু পড়ানোর কাজটিই করে গেছেন। অথচ এখন ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকেরা পড়ানোর কাজটি প্রথমেই শুরু করবেন না।

এখন চারটি ধাপে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে হবে। কোনো বিষয় পড়ানোর আগে ওই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা বা জ্ঞান আগে যাচাই করে নিতে হবে। অর্থাৎ বিষয়টি নিয়ে তারা কী জানে কতটুকু জানে, এটি আগে দেখতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষক অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে যাচাই করবেন, তাঁদের জানার বিষয়গুলো ঠিক আছে কি না। তৃতীয় ধাপে গিয়ে শিক্ষক পড়ানোর কাজটি করবেন। শেষ ধাপে শিক্ষক কোনো নমুনা দিয়ে যাচাই করবেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি সম্পর্কে আদতে কতটুকু ধারণা বা জ্ঞান লাভ করল।

শুধু পাঠদানেই পরিবর্তন আসেনি, পরিবর্তন এসেছে মূল্যায়ন বা পরীক্ষাপদ্ধতিতেও। এখন জিপিএ বা নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের যাচাই করা হবে না। শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জন করিয়েই কেবল পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে। ব্যাপারটি গতানুগতিক ধারণায় জটিল মনে হতে পারে। এরপরও এটি একটি দারুণ পদ্ধতি হয়ে উঠবে যদি সবকিছু ঠিকমতো কাজ করে। কিন্তু শিক্ষকেরাই যদি ব্যর্থ হন সবকিছু বুঝে নিতে, তবে ঢাকঢোল পেটানো এ শিক্ষাক্রম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই পুরো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সহজ উপায়গুলোকে কাজে লাগানো উচিত।

এখন অনলাইনের যুগ। বিভিন্ন বিষয়ের ৫-১০টি করে ভিডিও ক্লাস তৈরি করে শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া যায়। এসব নমুনা ক্লাস দেখে শিক্ষকেরা সহজেই বুঝে নিতে পারবেন কীভাবে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ভিডিওর শেষে দেখিয়ে দিতে হবে, এসব ক্লাসে পাঠদানপ্রক্রিয়ার চারটি ধাপ কীভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। লক্ষ করছি, শিক্ষক প্রশিক্ষণে নতুন শিক্ষাক্রমের তাত্ত্বিক ধারণা দেওয়ার জন্য বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে। শ্রেণিশিক্ষকদের আসলে শিক্ষাক্রমের তত্ত্বগত ধারণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

বড়জোর পুরোনো শিক্ষাক্রমের সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমের পার্থক্যগুলো মোটাদাগে দেখানো যায়। শিক্ষাক্রমের ধারণা দেওয়ার জন্য আলাদা কনটেন্ট তৈরি করে অনলাইনে দিয়ে দিলেই হয়। যার দরকার সেখান থেকে দেখে নেবে। আর মূল্যায়নপদ্ধতির জন্য যে অ্যাপস তৈরির কথা বলা হচ্ছে, তা দ্রুত তৈরি করে দিলে শিক্ষকেরা সেখানে সহজেই শিক্ষার্থীদের তথ্য সংরক্ষণ করার কাজ শুরু করতে পারবেন। এ নিয়ে প্রশিক্ষণে যত কথাই বলা হোক, তা কোনো কাজে আসবে না যদি অ্যাপস বা সফটওয়্যারই না থাকে।

সবচেয়ে বড় কথা, দুই দিন বা চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকেরা আসলে কতটুকু শিখতে পারেন কিংবা কতটুকুই আর তাঁদের শেখানো যায়! তাই এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য সময় আর অর্থ ব্যয়ের প্রকল্প থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’ আসলেই যদি কার্যকর করতে হয়, তবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পরপরই তাঁদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য দেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও কলেজগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। অন্তত ছয় মাসের সুনির্দিষ্ট সিলেবাসভিত্তিক কোর্স করিয়ে তাঁদের শ্রেণিকক্ষে পাঠানো উচিত। আর পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ‘শিক্ষক সহায়িকা’ও শিক্ষকদের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে, যাতে তা অনুসরণ করে তাঁরা ক্লাস নিতে পারেন।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক