সব ধরনের বাধাবিপত্তির পরও পাকিস্তান একটি নির্বাচন–পরবর্তী পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এ নির্বাচন নিয়ে মূল যে শঙ্কা দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে, তা হলো এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন। যা হোক, নির্বাচনের ফলাফলে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে ইতিবাচক ধারণা দেবে।
৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিনে লাহোরে ১৮ ঘণ্টার বেশি সময় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। একটি অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে এবং জনগণের প্রতিদিনকার জীবনযাপনে হস্তক্ষেপ করে, এ ঘটনা তার একেবারে নিখুঁত দৃষ্টান্ত। একইভাবে ঘটনাটি থেকে উঠে আসে, সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক স্বাধীনতার বৈধ অধিকার খর্ব করে একটি রাষ্ট্র কীভাবে একটি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
সব ধরনের শায়েস্তার ব্যবস্থা ও নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করার পরও পাকিস্তানের তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) সঙ্গে সম্পর্কিত প্রার্থীরা সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। দলটির প্রতি অনুগত ভোটাররা তাঁদের প্রার্থীদের হতাশ করেননি। প্রকৃতপক্ষে ৮ ফেব্রুয়ারির আগে নির্বাচনী উত্তাপ পিটিআই বনাম রাষ্ট্র—এ দুয়ের মধ্যে টগবগ করে ফুটছিল।
নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্র পিটিআইয়ের নেতা–কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে। আর পিটিআইয়ের সমর্থকেরা এবং নিরপেক্ষ ভোটাররা ভোট দিয়ে তার উত্তর দিয়েছেন একেবারে নিষ্করুণভাবে। এমনকি দল বদল করেও অনেক ভোটার তাঁদের ভোট দিয়েছেন। সংক্ষেপে বললে পিটিআইয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর এ প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষ যথাসাধ্য সমর্থন দিয়েছেন।
৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকৃত কৃতিত্ব পাকিস্তানের ভোটারদের। তাঁরা তাঁদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভোট দিতে গেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৮ ফেব্রুয়ারিকে প্রতিফলের দিন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আর এ ক্ষেত্রে ফলাফল সমান–সমান। নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্র পিটিআইয়ের নেতা–কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে। আর পিটিআইয়ের সমর্থকেরা এবং নিরপেক্ষ ভোটাররা ভোট দিয়ে তার উত্তর দিয়েছেন একেবারে নিষ্করুণভাবে। এমনকি দল বদল করেও অনেক ভোটার তাঁদের ভোট দিয়েছেন। সংক্ষেপে বললে পিটিআইয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর এ প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষ যথাসাধ্য সমর্থন দিয়েছেন।
৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দুটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। এক. পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রপ্রিয়। দুই. সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানিরা তাঁদের অধিকার প্রয়োগে ব্যাকুল।
এ যুক্তিতে বলা যায়, সাধারণ পাকিস্তানিরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে তাঁরা এমন একটি রাষ্ট্রের নির্দেশের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে চান না, যে রাষ্ট্র নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে। ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকে এটা বেরিয়ে আসছে যে সুনির্দিষ্ট সময় ধরে একটা হাইব্রিড মডেলের সরকার পাকিস্তানকে শাসন করুক, সেটা সাধারণ মানুষ চান না। এ নির্বাচন দেখাচ্ছে, পাকিস্তানে অন্য কোনো মডেল নয়, কেবল ১৯৭৩ সালের সংবিধানই জয়ী হতে পারে।
একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন নির্বাচন–পরবর্তী পর্যায় এসে যাওয়ায়, সেখানেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এসে গেল।
প্রথমত, প্রদেশ ও কেন্দ্র দুই ক্ষেত্রে প্রলোভন ও ভয় দেখানোর (স্টিক অ্যান্ড ক্যারট) কৌশল প্রয়োগ করে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাবে। প্রলোভন–প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা বড়সড় একটা মন্ত্রিসভা দেখব। সে ক্ষেত্রে দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছে, তখন জনগণের পকেটের অর্থ ব্যয় করে বড়সড় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রে জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, যেকোনো জোট সরকারকে তার অস্তিত্বের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জোট সরকার ঐকমত্যে পৌঁছাতে সমস্যায় পড়ে। ভঙ্গুরতাই এ ধরনের সরকারের স্মারক হয়ে ওঠে এবং নির্ধারিত সময়ের আগে সরকার ভেঙে পড়ে। এমনকি অর্থনৈতিক খাতে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতেও তারা সমস্যায় পড়ে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানে জোট সরকার হলে তারা আগামী মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ছাড় করাতে সক্ষম হবে। কিন্তু এরপর দীর্ঘ মেয়াদে আইএমএফের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি (ধারণা করা হচ্ছে তিন বছরের) পেতে তারা সমস্যায় পড়বে।
তৃতীয়ত, অনেকগুলো দল নিয়ে একটা জোট সরকার হলে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর মিলমিশ বা সমঝোতার ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু এ জগাখিচুড়ি ধরনের সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের (দেশি ও বিদেশি) মধ্যে সন্দেহের জন্ম হয়। দেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে না দেখলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হন না।
দৃষ্টান্ত হিসেবে পাকিস্তানে বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং বিনিয়োগকারীরা যাতে তাঁদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নিয়ে যেতে পারেন, তার নিশ্চয়তা দিতে বেসামরিক–সামরিক মিলিয়ে একটা প্রকল্প দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু একটা ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু থাকলে সেই ভয় ও প্রলোভন দেখানোর (স্টিক অ্যান্ড ক্যারট) প্রকল্প মাঠে মারা যেতে বাধ্য। তাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃস্বপ্ন তৈরি হবে।
চতুর্থত, গত এক দশকে বিভিন্ন জাতীয় সংস্থার জরিপ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন র্যাঙ্কিং থেকে বিশ্ব এ ধারণা পাচ্ছে যে গত এক দশকে পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে দেশের বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। এ কারণে ধনী বন্ধুদেশগুলোও পাকিস্তানে বিনিয়োগ করতে বিমুখ। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, কিন্তু পাকিস্তানের যে আইন, সে আইনের অধীন তারা বিনিয়োগ করবে না।
বন্ধুদেশগুলো তাদের দেশের আইন অনুযায়ী কিংবা তৃতীয় কোনো দেশের আইন, যাতে দুই দেশের যৌথ সম্মতি আছে, সে রকম কোনো চুক্তিতে পাকিস্তানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
পঞ্চমত, স্বতন্ত্রদের এই উত্থান পাকিস্তানে যে সামাজিক–রাজনৈতিক অসন্তোষ টগবগ করে ফুটছে, সে বিষয়কে ইঙ্গিত করছে। পিটিআই–সমর্থিত প্রার্থীদের কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন, সেটাকে অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের ক্ষত যে কতটা অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে, এটা তার ইঙ্গিত।
অসন্তোষ প্রশমনের ব্যবস্থা (বিশেষ করে ভোটাররা যখন তাঁদের গণতান্ত্রিক রায় দিয়েছেন) না করতে পারলে পাকিস্তান একেবারে অভ্যুত্থানের প্রান্তসীমায় থেকে যাবে। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে তার পুলিশি পোশাক পাল্টে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বেশভূষা ধারণ করতে হবে।
সংক্ষেপে বললে, স্বতন্ত্র জনপ্রতিনিধিদের এই উত্থান পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য—দুয়ের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য। মিথ্যা অজুহাতে কারাবন্দী নেতাদের মুক্তির দাবিতে তাঁরা আরও সোচ্চার হতে বাধ্য। এ বাস্তবতায় সংঘাত–সহিংতাপূর্ণ পরিবেশে পাকিস্তানকে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট সমর্থন দেওয়া আইএমএফ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
কায়সার রশীদ পাকিস্তানের কলাম লেখক
পাকিস্তানের দ্য নেশন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত