'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনে শ্লোগান দিচ্ছেন এক নাগরিক।
'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনে শ্লোগান দিচ্ছেন এক নাগরিক।

বর্ণবাদের আঘাতে হুমকির মুখে মার্কিন গণতন্ত্র

আমেরিকা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি বর্ণবিদ্বেষী প্রকল্প হিসেবেই। আদিবাসীদের থেকে জমি চুরি, ক্রীতদাস শ্রম এবং কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ এসবের প্রমাণ। কিন্তু ‘মেইক এমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা ‘মাগা’ চরমপন্থীরা এই সত্য মুছে ফেলতে চায়।

মাগা কিন্তু শুধু ইতিহাসকেই যে নীরব করতে চায়, এমন নয়। আর এই কাজে যে শুধু মাগাই উদ্যোগী এমনও নয়। আমেরিকা তার জাতিগত ইতিহাস এবং এর বর্তমান পরিণতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখনো স্বাভাবিক করতে পারেনি। তাই আমেরিকার গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে এক বিপজ্জনক মৈত্রী আছে। তাদের যে বর্ণবাদী ভিত্তি, তা দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সে নিয়ে আলোচনা হয় সবচেয়ে কম।

আমেরিকায় জাতি-সচেতন ইতিহাস এবং জ্ঞানের চর্চা আছে। বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তিকে নিশ্চিত করার এক কঠোর সংগ্রাম আছে। এর বিরুদ্ধে আক্রমণ বাড়ছে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আর এই বিপদ শুধু অ-সাদা বর্ণের মানুষের জন্যই নয়। যারা জাতিগত ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের পক্ষের মানুষ, তারাও এই বিপদের আওতা এড়াতে পারবে না।

কে আমাদের লোক আর কে নয়, এই কথা দিয়েই ফ্যাসিবাদী শাসনের আলাপ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক নাটকের দৃশ্য উন্মোচিত হচ্ছে। অনেক দিক দিয়ে অসন্তুষ্ট জনসাধারণ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বর্ণবাদী আখ্যানের। এতে আক্রান্ত অন্য বর্ণের মানুষও ফুঁসে উঠছে। যাঁরা আমেরিকার গণতন্ত্রের এই ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে বিলাপ করেন, তাঁরা এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য কোনো চেষ্টাই করছেন না। তাঁরা যেন বুঝতে চাইছেন না যে জাতিগত সমস্যার বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আমেরিকায় গণতন্ত্র রক্ষা করা যাবে না।

কালো ও অন্যান্য অ-সাদা মানুষের জেগে ওঠার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু সমালোচনামূলক জাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ কালো মানুষের ইতিহাস এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলন থেকে অর্জিত সমগ্র অবকাঠামোর বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ। এর ফলে আমেরিকার বহুজাতিক গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু অনেকে এই কথাটা মুখে আনতেও রাজি নন। আর যে আক্রমণ দেখা যায় না, যার কোনো নাম নেই, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। এর ফলাফল হয় বিপর্যয়কর।

আমাদের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে চলেছে যে শক্তি, মূলধারার মিডিয়াগুলো তার সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের মতোই অক্ষম এখনো। ৬ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকেরা ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করেছিল। বর্ণবাদী ও শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা সেখানে স্লোগান দিয়েছিল, ‘আমরা আমাদের দেশ ফিরে চাই।’ এই স্লোগান বলছে যে আমেরিকা তার গণতন্ত্রকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। গণতন্ত্র হারিয়ে ফেলার বিশাল গল্পে এই স্লোগান এক পাদটীকা মাত্র। এই স্লোগান দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে এই জাতি কার, কে এই দেশ শাসন করবে। প্রচারমাধ্যম যেন এই বর্ণবাদী আখ্যান তাদের কাভারেজ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে।

কে আমাদের লোক আর কে নয়, এই কথা দিয়েই ফ্যাসিবাদী শাসনের আলাপ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক নাটকের দৃশ্য উন্মোচিত হচ্ছে। অনেক দিক দিয়ে অসন্তুষ্ট জনসাধারণ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বর্ণবাদী আখ্যানের। এতে আক্রান্ত অন্য বর্ণের মানুষও ফুঁসে উঠছে। যাঁরা আমেরিকার গণতন্ত্রের এই ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে বিলাপ করেন, তাঁরা এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য কোনো চেষ্টাই করছেন না। তাঁরা যেন বুঝতে চাইছেন না যে জাতিগত সমস্যার বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আমেরিকায় গণতন্ত্র রক্ষা করা যাবে না।

ট্রাম্পের বিষাক্ত মিথ্যাগুলোর লক্ষ্য কারা? ফিলাডেলফিয়া, ডেট্রয়েট, আটলান্টা ও ফিনিক্সের মানুষেরা। সেখানে কোনো ভোটার তাঁকে হোয়াইট হাউসে যেতে দিতে চায়নি? কালো ও বাদামি বর্ণের ভোটার। কোনো নির্বাচনে কর্মীরা এই ‘নোংরা’ কাজ করেছে? বিশেষ করে আফ্রিকান আমেরিকান নারীরা।

ট্রাম্প যে নির্বাচনে তাঁকে চুরি করে হারানো হয়েছে বলেন, এর একটা বর্ণবাদী চেহারা আছে। এই চেহারাকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে এক বিপজ্জনক এবং বিভ্রান্তিকর সুড়ঙ্গের পথ খুলে যাবে। ট্রাম্প–সমর্থকেরা ক্যাপিটল আক্রমণ করার দিন যে কনফেডারেট পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করছিলেন, এটা কি কোনো আকস্মিক ঘটনা? এই পতাকা তো আমেরিকার গৃহযুদ্ধে দাস প্রথা, কালো মানুষদের কোনোরকম নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধতার প্রতীক।

কংগ্রেসম্যান জেমি রাসকিন সেই অল্প কয়েকজনের একজন, যিনি মাগার বর্ণবাদী চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কই একই উদ্দেশ্য তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তবুও আমাদের দাসপ্রথা সমর্থনের অতীত যেন আমরা ভুলে গেছি। আমাদের নেতাদের নির্বাচনী বক্তৃতার কোথাও সেই কথা উঠে আসে না।

কবি ল্যাংস্টন হিউজ লিখেছেন, ‘আমেরিকার কালো মানুষদের বলে দিতে হবে না যে ফ্যাসিবাদ কী। আমরা তা জানি।’ এই চেতনা কালো মানুষের অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখা।

টনি মরিসন বলেন যে একটা অচ্ছুত শ্রেণির সৃষ্টি করা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রথম ধাপ। এই ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রকাশ্য এবং তকমা লাগিয়ে তার শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে, দানব হিসেবে তুলে ধরে।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত আমেরিকান লেখক কালো মানুষ টনি মরিসন আমেরিকার সবচেয়ে নিষিদ্ধ লেখকদের একজন হয়ে উঠেছেন। এ যেন এক পরিহাস। এতক্ষণ যে সংকটের কথা বলা হলো, তা অনেক আগেই মরিসন ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। এই যে কালো মানুষের জাগরণ এখন নিষিদ্ধ বিষয় হয়ে উঠছে, তা নিয়ে আমাদের আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত ছিল।

মাগা–সমর্থকেরা যদি আমাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চায়, তবে আমাদের আরও বেশি করে তর্কে নামতে হবে। মনে রাখতে হবে এ শুধু কোনো তত্ত্ব, কোনো চর্চা বা মূল্যবোধের চেয়ে বড় কিছু টিকিয়ে রাখার লড়াই। এ লড়াই ঝুঁকির মুখে থাকা আমেরিকার গণতন্ত্র রক্ষার। বর্ণবাদী অন্যায়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে আমেরিকা যে ইতিহাস আর চিন্তাগুলো অর্জন করেছে, সেগুলোকে শক্তিশালী না করে আমরা গণতন্ত্রকে বাঁচাতে পারব না।

এখন এই আক্রমণ এমন কিছুর ওপর এসেছে, যা বেশির ভাগ আমেরিকান সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এই আক্রমণ এসেছে দেশের ওপর। আর আমেরিকাকে, বর্ণবাদীরা যাদের ‘অপর’ বলে, তাদের বাদ দিয়ে বাঁচানো যাবে না। আর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার লড়াইয়ের ইতিহাস ভুলে গেলে তা সম্ভব নয়। আমাদের একমাত্র উপায় হলো লড়াই করা। আমাদের ইতিহাস বলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা, আমাদের বাস্তবতাকে জেনে তা পরিবর্তন করতে ভোট দেওয়া।

  • কিম্বারলে ডব্লিউ ক্রেনশ আফ্রিকান আমেরিকান পলিসি ফোরামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন