১২ জুলাই একই সময়ে ঢাকায় দেড় কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি বড় দুটি সমাবেশ করেছে। দুই সমাবেশ থেকে তারা এক দফা ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোনো নির্বাচন হবে না। তাদের দাবি একটাই, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতেই নির্বাচন হতে হবে। এটাই তাদের ‘এক দফা।’
এই যে দুই পক্ষের অনড় অবস্থান—দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে? আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, বিএনপি যতই অনড় অবস্থান দেখাক, শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে আসবে। আবার বিএনপি নেতাদের বিশ্বাস হলো, আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮–এ সাজানো নির্বাচন করে যেভাবে পার পেয়ে গেছে, এবার আর সেটি পারবে না। বিদেশিদের চাপে কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, এবার তাদের দাবি মানতেই হবে। দুই দল সংলাপ নিয়েও কথা বলেছে। তবে সেটি শর্তসাপেক্ষ। আগে দাবি মেনে নাও, তারপর সংলাপ।
শুক্রবার প্রথম আলোয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শাহদীন মালিক ও ড. সাখাওয়াত হোসেন এবং কূটনীতিক তৌহিদ হোসেনের প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছে। তাঁদের ভাষাভঙ্গি ভিন্ন হলেও মূল কথা এক—আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। অনড় অবস্থান সত্ত্বেও আলোচনার দরজা এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। দৃশ্যের সামনে না হোক, আড়ালেও আলোচনা হতে পারে। গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো আলোচনা, তর্ক–বিতর্কের মধ্য দিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি মীমাংসায় আসা। তবে আমাদের রাজনীতিকেরা বিপরীত পথে হাঁটতে অভ্যস্ত। অতীতে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আলোচনার টেবিলে হয়নি। হয়েছে রাজপথে, রক্তাক্ত ও প্রাণঘাতী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে।
ঢাকা শহরে একই দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ, অথচ সংঘাত–সংঘর্ষ হয়নি; পুলিশ বাধা দেয়নি। কেউ কেউ একে আদর্শ বা মডেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু কাজটি যে সরকারি দল কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী স্বেচ্ছায় করেনি, সেটা হলফ করে বলা যায়। তারা বিদেশি অতিথিদের সামনে নিজেদের গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু দেখাতে চেয়েছেন। তারপরও আমরা তাদের স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এই কথাও বলব, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনীতিকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছেন যে সমাবেশে সংঘাত না হলে শিরোনাম হয়। প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তাঁরা এই ধারা বজায় রাখবেন কি না। অতীতের মতো গায়েবি মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের ফের হয়রানি করা হবে কি না।
আজ নির্বাচন নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে, এটা মূলত আমাদের গণতন্ত্রের সংকট। শাসনব্যবস্থার সংকট। এই সংকট যঁারা তৈরি করেছেন, তঁাদেরই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান হলে দেশ মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যদি সেটা না হয়, রাজপথেই যদি উভয় পক্ষ শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে, অনুমান করা কঠিন নয়। ২০১৩-১৪ কিংবা ২০০৬-০৭–এর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।
আমাদের গণতন্ত্রের প্রথম সমস্যা হলো ক্ষমতাসীনেরা দল ও সরকারের বিভাজনরেখাটি পুরোপুরি মুছে ফেলেছেন। দ্বিতীয় সমস্যা হলো বিরোধী দলে থাকতে তাঁরা জনগণের মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে খুবই সোচ্চার থাকেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই অধিকারগুলো খর্ব করতে থাকেন।
নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, দুভাবে এর সমাধান হতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অথবা রাজপথে শক্তি পরীক্ষায়। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হলে একটি উইন উইন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনসহ অনেকেই বলেছেন, সংবিধানের ভেতরে থেকেও সেটা সম্ভব।
১৯৯০–এ স্বৈরাচারের পতনের পর আন্দোলনকারী দলগুলো আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান বের করেছিল, সংবিধান পরিবর্তন না করেই। আজও রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে একটি সমাধান বের করা অসম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, সেই সদিচ্ছা তঁারা দেখাবেন কি না। একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেবেন কি না।
সরকারের মন্ত্রীরা, সরকারি দলের নেতারা বলেন, তাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচন চান। বিরোধী দলও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তাহলে সমস্যা কোথায়? নির্বাচন হলো ‘জনগণের ইচ্ছার’ চূড়ান্ত প্রকাশ। সেটি তখনই সম্ভব, যখন সব দল ও জনগোষ্ঠী সেই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। কোনো দল বা পক্ষকে বাইরে রেখে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।
পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর উচিত ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করে দেশবাসীকে দেখানো যে দলীয় সরকারের আমলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। সেটি তাঁরা পারেননি। বিএনপি ১০ বছর আন্দোলন করে যতটা না নির্দলীয় সরকারের দাবির ন্যায্যতা দিতে পেরেছে, তার চেয়ে সরকার বেশি ন্যায্যতা দিয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ‘জবরদস্তির’ নির্বাচন করে।
সুষ্ঠু ভোটের জন্য অগণিত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, দেশকে অপরিমেয় অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। তারপরও গণতন্ত্র কেন অধরা থেকে গেল, কেন স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও ভোটের জন্য আন্দোলন করতে হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই খুঁজতে হবে।
আজ নির্বাচন নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে, এটা মূলত আমাদের গণতন্ত্রের সংকট। শাসনব্যবস্থার সংকট। এই সংকট যঁারা তৈরি করেছেন, তঁাদেরই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান হলে দেশ মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যদি সেটা না হয়, রাজপথেই যদি উভয় পক্ষ শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে, অনুমান করা কঠিন নয়। ২০১৩-১৪ কিংবা ২০০৬-০৭–এর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।
দুই দলের ‘এক দফার’ জন্য জনগণের যে দফারফা হবে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com