কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একের পর এক যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটছিল, তা দেখে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সবার মনে একটিই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটি হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শেখ হাসিনা অতীতে যেভাবে সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন, এবারও কি তা পারবেন?
২০০৮ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তারপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর যে তিনটি নির্বাচনের পর তিনি গদি ধরে রাখেন, সেগুলো খুবই বিতর্কিত ছিল। এই নির্বাচনগুলো মোটেও অংশগ্রহণমূলক ছিল না। তিনি ক্ষমতাকে এতটাই সুসংহত করেছিলেন যে তাঁকে প্রায় অজেয় বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে চলা নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহে সোমবার একটি প্রচণ্ড মর্মান্তিক মোচড় যোগ হয়। হাসিনা আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করে তাঁর ১৫ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটান।
অল্প কয়েক দিন আগে শান্তিপূর্ণভাবে যে ছাত্র বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল, তা দ্রুত একটি দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়ে পড়ে, যা হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের প্রতি মানুষের গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে দেয়। একই সঙ্গে তিনি দেশে-বিদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেই উন্নয়নকে ম্লান করে দেওয়া লাগামহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও উচ্ছৃঙ্খলতার নগ্ন চেহারা এই বিক্ষোভের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার মোচড় আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নাগরিক স্বাধীনতার অবক্ষয় ঘটিয়ে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে একজন নেতা তাঁর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেন না। হাসিনার মেয়াদকালে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এমনকি অর্থনৈতিক গতির দিক থেকে তার সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে।
হাসিনার মেয়াদকালে দেশটির মাথাপিছু আয় এক দশকে তিন গুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের অনুমান, গত ২০ বছরে দেশটির আড়াই কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাসিনার সরকার দেশীয় তহবিল, ঋণ এবং উন্নয়ন সহায়তার সমন্বয়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতুর মতো অনেক উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তবে এই অর্থনৈতিক অর্জনের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলগুলোর ভোট বর্জন, নামমাত্র ভোটার উপস্থিতি ও সহিংসতা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
হাসিনার সরকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ক্রমবর্ধমানভাবে কঠোরভাবে বলপ্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা সারা দেশে ভয় ও দমনের পরিবেশ তৈরি করে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের সমালোচনার কণ্ঠরোধ করতে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষ করে অনলাইনে সমালোচনামূলক কনটেন্ট প্রচার ঠেকাতে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থানকে সংহত করার জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেন। নাগরিক অধিকারগুলো পরিকল্পিতভাবে সংকুচিত করেন। হাসিনার মেয়াদকালে একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পারদ চড়েছে, অন্যদিকে গরিব ও ধনীর বৈষম্য বেড়েছে। ব্যাংক কেলেঙ্কারি বেড়েছে। ঋণখেলাপিদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে ব্যাপক দুর্নীতি মিলিত হয়ে জনগণের অসন্তোষকে প্রচণ্ডভাবে উসকে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক যে ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হাসিনাকে পতনের দিকে নিয়ে গেল, তার শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের একটি সাধারণ দাবি থেকে। কোটা আন্দোলনের শুরুটা খুব শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে সেটি অন্যান্য অভিজাত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর তাতে সারা দেশে সাধারণ জনগণ জড়িয়ে পড়েন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন, যখন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা শুরু করেন। এটি একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনকে বৃহত্তর বিদ্রোহে রূপান্তরিত করে।
এই বিদ্রোহ মোকাবিলায় হাসিনার নেওয়া সব প্রতিরোধ ব্যর্থ হতে থাকে। গত মাসের শেষের দিকে ছাত্রদের দমন করতে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। এটি ব্যাপক সংখ্যক জনগণের ক্ষোভকে প্রজ্জ্বলিত করে। ‘দেখামাত্র গুলির’ আদেশসহ কঠোর কারফিউ জারি আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছিল। শেখ হাসিনা বিক্ষোভকারীদের ‘রাজাকার’ হিসেবে তকমা দেওয়ায় তাঁদের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।
বিক্ষোভের গতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা তাঁদের অভিভাবক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের সমর্থন পেয়ে যান। আন্দোলনটি যে দাবি নিয়ে শুরু হয়েছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত হাসিনার পদত্যাগের দাবি হয়ে ওঠে। একটি নায়কোচিত ও মহিমান্বিত আসন থেকে শেখ হাসিনার আকস্মিক পতন সেই সব নেতার জন্য একটি হুঁশিয়ারিমূলক দৃষ্টান্ত হতে পারে, যাঁরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক স্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
হাসিনার পূর্বসূরি স্বৈরাচার এরশাদ গদিচ্যুত হয়ে পালাননি; কিন্তু হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। কুখ্যাত স্বৈরশাসকদের মতো অজ্ঞাত স্থান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে পলায়ন এবং তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে উন্মত্ত জনতার লুটপাট বিভিন্ন সিনেমার দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার পতন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্য যে বার্তা দেয়, তা হলো আর্থসামাজিক অগ্রগতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূক্ষ্ম ভারসাম্য থাকতে হবে।
সৈয়দ মুনির খসরু আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইপিএজি ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ