বাংলাদেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু উন্নয়নের অজুহাতে সুশাসনের দায় পালন ও গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত করা যাবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এ রকম একটা কথা চালু হয়েছে যে উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রের সংকোচন হতে পারে। কিন্তু এ রকম ধারণা ক্ষমতাসীনদের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আমরা মনে করি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চয়ই একে অপরকে বাতিল করে না। আমাদের যুগপৎ এই চারটি চাহিদারই পরিপূরণ চাই।
উন্নয়নের কৃতিত্ব অবশ্যই বর্তমান সরকারের প্রাপ্য। তাহলে সুশাসন ও গণতন্ত্রের দায় পূরণ না হওয়ার ব্যর্থতার দায় কে নেবে? সরকার তা এড়াতে পারে না। এ ব্যাপারে আন্তরিক না হলে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এমনিতেই বাড়ে, সঙ্গে জবাবদিহির দায় অকার্যকর হলে তা যেন চক্রবৃদ্ধি হারেই বাড়তে থাকে। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচার কিংবা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্যে সে চিত্র ফুটে উঠছে।
এদিকে সরকারে জনপ্রতিনিধিদের অংশীদারত্ব কমেছে, বিপরীতে ক্ষমতা বাড়ছে সব ধরনের আমলাদের। এখন রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতা জাহির করতে গিয়ে জনগণ থেকে দূরে সরে অন্যান্য গোষ্ঠীগত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, বলা যায় নিঃস্বার্থ সম্পর্কের সংস্কৃতি ঘুচে গিয়ে স্বার্থের সংস্কৃতি বড় হচ্ছে।
চিন্তাচেতনায় এ দেশে মোটাদাগের একটি বিভাজন সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উজ্জীবনকালের ঘটনাবলির নিরিখে এই বিভাজনকে গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান সমন্বয়বাদী ও স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের যে ভাবাদর্শ হিন্দু-মুসলিম দুই স্বতন্ত্র জাতি, সে স্বাতন্ত্র্যবাদীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতিচেতনার ওপর জোর দিয়েছেন। সমন্বয়বাদীরা দেশ-ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ভিত্তিতেই বাঙালি পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। এঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষেই কথা বলেছিলেন।
বলা বাহুল্য, বিএনপিকে স্বাতন্ত্র্যবাদী ও আওয়ামী লীগকে সমন্বয়বাদী রাজনীতির ধারক গণ্য করা যায়। তবে সূক্ষ্ম বিচারে উভয় পক্ষে চেতনার ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যত্যয় দেখতে পাব। প্রয়াত কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই বিবেচনা থেকেই বিএনপিকে একালের মুসলিম লীগ আখ্যায়িত করতেন এবং আওয়ামী লীগের বিস্তর সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত পক্ষেই অবস্থান বজায় রাখতেন।
এখন কথা হলো বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে খোদ নির্বাচনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সহজ কথা হলো, যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা সংহত করাই মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে চেতনা রক্ষার গরজ বাদ দিয়ে সহজে নির্বাচন জেতার ফিকিরই গুরুত্ব পাবে। কথা হলো লক্ষ্য হাসিলের সহজ পথ এবং লোকচক্ষুকে ফাঁকি দেওয়ার সোজা রাস্তা সব সময় খোলা থাকে না। প্রকৃত সমন্বয়বাদী বিবেকবান মানুষ যদি এখন প্রশ্ন করেন সমাজে উদার, মানবিক, গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনীতি, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার যে অবক্ষয় ঘটল তার দায় কে নেবে? সমাজকে ধর্মান্ধতা ও সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার সুড়ঙ্গে ঠেলে দেওয়ার দায় কার? আঙুলটা কাদের দিকে উঠবে, সে কথা বোঝা সহজ।
পশ্চিমের যেসব দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে, তার পেছনে রেনেসাঁসের সময় থেকে সূচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার প্রভাব আছে, ভূমিকা আছে শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লবসহ উন্নত গবেষণা, আবিষ্কার-উদ্ভাবনসহ নানা মানবিক বিকাশের। বিপরীতে আমাদের সমাজ চিন্তাচেতনায় পিছিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বা স্মার্ট হলেও চিন্তাচেতনায় ষাটের দশকের চেয়ে পিছিয়ে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে সে আমলের বাম প্রগতিশীলদের ক্ষেত্রেও। দেশের অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক উন্নতি নিয়ে কারও দ্বিমত নেই, একইভাবে মানুষের অবক্ষয়, নীতিনৈতিকতার পতন কিংবা সহিষ্ণুতার সংকট যে চরম রূপ নিয়েছে, সে কথাও অস্বীকার করা যাবে না। এর দায় আমরা এককভাবে সরকারের ওপর চাপাব না, আবার একেবারে দায়মুক্তিও দিতে পারব না।
এ-ও উদ্বেগের বিষয় যে এ আমলে সরকারে জনপ্রতিনিধিদের এবং জনগণের অংশীদারত্ব মানে ও পরিমাণে উভয়ই কমেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো দিনে দিনে তা আরও কমছে। ফলে নির্বাচিত ব্যক্তিরা (যাঁরা আদতে জনপ্রতিনিধি) নিজেদের যতই ক্ষমতাবান ভাবুন এবং সত্যিই তাঁরা অর্থ ও প্রভাবে যতই শক্তিশালী হোন, তাতে জনগণের কিছুই যায় আসে না। কারণ, অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কাউকেই তাঁরা সক্রিয় ও ফলপ্রসূভাবে পাশে পান না।
সেতু, সড়ক, মেট্রো এবং আরও চোখধাঁধানো উন্নতি নিশ্চয়ই তাঁদের ভালো লাগে, কাজেও আসে, কিন্তু এসব পাওয়ার পরও মানুষ আরও কথা বলবে, আরও চাইবে। বলা এবং চাওয়া, নিজের জন্য এবং অপরের জন্য, এটা স্বাভাবিক মানবিক বৈশিষ্ট্য। যে সমাজে মানুষ কেবল নিজের বা নিজেদের জন্যই চায়, তা উন্নত মানবসমাজ নয়। সব সময় আইনের কল বসিয়ে মানুষের মতপ্রকাশকে পরিমাপ করতে থাকলে মানবিক জীবন ক্ষুণ্ন হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ব্যাহত হয়। বলে রাখা দরকার, আইনের প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করছে না, তবে এ হলো ওষুধের মতো, প্রয়োগ করতে হয় বুঝেশুনে, মাত্রা ঠিক রেখে। তাই বলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বা ক্ষমতার জোর খাটিয়ে এমন আইন তৈরি করা যাবে না, যা মত ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত করে বন্ধ করে দেয়।
কথা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে মুক্তিযুদ্ধ, যাতে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, তার চেতনা ও শাঁস হলো গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীরা তা-ই বিশ্বাস করতেন। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সে অধিকার সবটাই অর্জিত হলো না আজও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেননি, সাহস করে বিশ্বব্যাংককেও চ্যালেঞ্জ জানাতে কসুর করেননি। এবার একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সাহস তাঁকে করতে হবে, সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। সাহসের প্রমাণ বা চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা তিনি অনেকবার দেখিয়েছেন। কথা হলো আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এটাই বাস্তবতা, অন্য কোনো মধ্যপন্থী বা প্রগতিশীল শক্তি দেশে নেই। এই যে মধ্যপন্থা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল আরও রাজনৈতিক দলের অভাব ঘটল, তার কিছু দায় আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। কেননা, সমধর্মী বা কিছুটা অগ্রসর চিন্তার দলের বিকাশে আওয়ামী লীগ থেকে এলাকাভিত্তিক বাধা তৈরি হয়। নিজেরাই মাঠজুড়ে খেলতে ও মাঠ দখলে রাখতে গিয়ে অন্যদের বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে বারবার।
রাজনৈতিক দলে চিন্তাচেতনার চর্চা বন্ধ হলে তার পরিণতি হয় মারাত্মক। সাম্প্রতিক কালে তার বিস্তর নজির দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভিন্নমত দমনে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে উপদলীয় কোন্দলে। গত কয়েক বছরে এ ধরনের যত খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আর এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা দলে অনুপ্রবিষ্ট জামায়াত-শিবিরের বা হাইব্রিডদের কর্মকাণ্ড আখ্যা দেওয়া যাবে না। সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন অবস্থায় একচেটিয়া ক্ষমতাভোগের ফলে এ ধরনের বিকার ঘটাই স্বাভাবিক। এ অবক্ষয় চলতে থাকলে তার খেসারত কেবল আওয়ামী লীগ দেবে না, দেবে জাতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চূড়ান্ত অপচয়ের মাধ্যমে। দেশে সুস্থ ধারার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা তৈরির জন্য আওয়ামী লীগকেও গরজ করতে হবে। সমাজের অন্যান্য শক্তিকেও এ নিয়ে ভাবতে হবে।
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক