মতামত

গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

‘আয়নাঘরে’ বন্দীদের দেয়ালে লেখাগুলো প্লাকার্ডে তুলে ধরে প্রতিবাদ জানান বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে।
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও সংগঠন ‘গুম’-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। অনলাইন পোর্টাল নেত্র নিউজের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ বিষয়ে সবাই দাবি তুলছেন, ‘আয়নাঘর’ বলে যে গোপন অবৈধ কারাগার রয়েছে, সে বিষয়ে তদন্ত করা হোক। অভিযোগ আছে, এই কথিত কারাগারে তাঁদেরই আটকে রাখা হয়, যাঁদের সরকারি বাহিনী ‘গুম’ করে ফেলেছে। এই কারাগারে আটক অনেকেই পরে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুম নিয়ে এক দশকের বেশি সময় ধরেই অভিযোগ করে আসছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কিন্তু সরকার বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে। নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে এ ধরনের একটি নিপীড়নকেন্দ্রের বিস্তারিত দেখানো হয়েছে।

২০১২-১৩ সাল থেকেই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে গবেষণা এবং লেখালেখি করার সূত্রে এই প্রপঞ্চের ব্যাপারে সবার সম্মিলিত সোচ্চার প্রতিবাদের তাগিদ দিয়ে এসেছি। দেশের স্বার্থেই এ ধরনের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়া দরকার।

সংবিধানে নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার যে এতে লঙ্ঘিত হয় এবং রাষ্ট্রের বাহিনীগুলো দায়মুক্তি লাভ করে, তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়া সবার কর্তব্য হিসেবেই সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে সবার প্রতিবাদ জানানোর তাগিদ ছিল।

চলতি বছরের মার্চ মাসে সেন্টার গভর্ন্যান্স স্টাডিজের পক্ষ থেকে আমরা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম, ‘হয়্যার আর দে?’ (কোথায় আছেন তাঁরা?)। তাতে আমরা গত তিন বছরে (২০১৯-২১) গুমের অভিযোগ উঠেছে এমন ৭১টি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছি। এই ৭১ জনের মধ্যে ১৬ জনকে মার্চ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি; ৫ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, ২২ জনের ব্যাপারে পরিবারের অভিযোগ ছিল যে তাঁদের ‘তুলে নেওয়া’ হয়েছে। এই অভিযোগের পর তাঁদের হয় আটক দেখানো হয়েছে বা তাঁদের জেলে পাওয়া গেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ৫২২ জন।

আমাদের এই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে স্বাধীন নিরপেক্ষ একটি কমিশনের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর আগে-পরে এই দাবি উত্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফর করে, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার পর সুস্পষ্ট ভাষায় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্ত করার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ তদন্ত কমিশন গঠন করতে বলেছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের সফর গুম এবং গোপন নির্যাতনকেন্দ্র থাকার এসব অভিযোগ বিষয়ে স্বচ্ছতার সুযোগ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে একটি স্বাধীন সংস্থা কীভাবে গঠন করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের দপ্তর তৈরি আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। সরকার চাইলে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, না গ্রহণ করার মধ্যে আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য একটা বার্তা আছে। সেটা ইতিবাচক নয়, তার প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক হবে না বলে অনুমান করা যায়।

এ বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া অতীতের মতোই। তারা অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বের হতে অনাগ্রহী। গুম ও নিখোঁজের পার্থক্যকে ইচ্ছাকৃতভাবেই গুলিয়ে ফেলার অতীত অবস্থানেই আছে সরকার। অতীতে আমি একাধিকবার যেসব প্রশ্ন করেছি, সেগুলোই আবার উল্লেখ করতে চাই। সরকার যদি জানে যে তাদের এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা নেই, তাহলে নিরপেক্ষ তদন্তে আগ্রহ নেই কেন? গুমের শিকার হওয়ার পর যাঁরা সৌভাগ্যবশত ফিরে আসেন, তাঁদের নীরবতা কিসের ইঙ্গিত দেয়? কেন সরকার এসব বিষয়কে কখনোই গুরুত্ব দিতে রাজি হয় না? একইভাবে সরকার কেন এখন এ ধরনের গোপন অবৈধ আটককেন্দ্র বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের দাবিকে অগ্রাহ্য করছে?

গুমের বিষয়ে এখনকার এই আলোচনার সময় দুটি বিষয় স্মরণ করা দরকার। প্রথমত গুমের অভিযোগ যে কত গুরুতর অভিযোগ এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো যেসব দেশে ঘটেছে, সেখানে কী ঘটেছে!

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (বলপূর্বক অন্তর্ধান), যাকে সহজবোধ্য বাংলায় ‘গুম’ বলেই বর্ণনা করব, তা মানুষের মৌলিক অধিকারের সবচেয়ে গুরুতর লঙ্ঘনগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। একে আন্তর্জাতিকভাবে ‘মানবমর্যাদার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে গণ্য করা হয় (দেখুন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব, ১৯৯২ A/RES/47/133, art.1)। একে বিবেচনা করা হয় ‘মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর এবং ঘৃণ্য অপরাধ’ হিসেবে (ওএএসের ঘোষণার প্রস্তাবনা)। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বলেছে যে বলপূর্বক অন্তর্ধান ‘মানুষের মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ, মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার গুরুতর এবং সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম লঙ্ঘন’ (১৯৯৪, A/RES/49/193; ১৯৯৬, A/RES/51/94;, ১৯৯৮, A/RES/53/150)। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধিতে বলা হচ্ছে যে সিস্টেম্যাটিক বা পদ্ধতিগতভাবে (অর্থাৎ উপর্যুপরিভাবে) কিংবা ব্যাপক আকারে ‘অন্তর্ধান’-এর অনুশীলন ‘মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ’ বলে বিবেচিত হতে পারে [অনুচ্ছেদ ৭(২)(১)]। বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এসব কথা বাংলাদেশের জন্যও সমপরিমাণ কার্যকর। সরকার এই অভিযোগের মাত্রা, বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে ওঠার পর সম্যকভাবে উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে র‍্যাব এবং তার সাতজন সাবেক ও বর্তমান অফিসারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময়ও যেসব কারণ দেখিয়েছে, তার মধ্যে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা আছে।

এ ধরনের গুমের ঘটনার জন্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলো পরিচিত। চিলিতে সেনাশাসক অগাস্তো পিনোশের ১৭ বছরের শাসনামলে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪২৮ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে চিলির ট্রুথ কমিশন এই তালিকা প্রকাশ করেছিল। বলা হয়ে থাকে, এর বাইরেও কিছু ঘটনা সম্ভবত থেকে গেছে। তারপর থেকে এসব গুমের সঙ্গে যুক্ত সেনাবাহিনীর অফিসার, সদস্য এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের বিচার করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি ব্যক্তি। স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়ার কারণে এ কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং চিলির কোনো সরকারের পক্ষেই সেটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ট্রুথ কমিশন গঠন, বিচারিক প্রক্রিয়া—সবই অভ্যন্তরীণভাবেই করা হয়েছে চিলিতে। কিন্তু তাতে সহযোগিতা করেছে জাতিসংঘ।

গুয়াতেমালাতেও গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৬০ থেকে ১৯৯৬) কমপক্ষে ৪৫ হাজার মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে থাকে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় গঠিত একটি কমিশন ১৯৯৯ সালে বলেছিল যে ছয় হাজারের বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। এ বছর মে ও জুন মাসে গুয়াতেমালার আদালত ১৫ জন সেনা ও পুলিশ অফিসারকে বিচারের মুখোমুখি করার আদেশ দিয়েছেন। গুয়াতেমালার সাবেক সরকারপ্রধানকেও একটি আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। পরে তাঁকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়, যা নাগরিকেরা এখনো মেনে নেননি। গুয়াতেমালার ক্ষেত্রে যা সম্প্রতি ঘটেছে, তা আরও বেশি উল্লেখযোগ্য। ১৯৮২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গুমের শিকার এমিল বুস্তামানতে লোপেজের কন্যা আনা ইসাবেল বুস্তামানতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির কাছে এ বছর অভিযোগ পেশ করেছেন বিচার চেয়ে।

ফলে যেসব দেশে এ ধরনের ঘটনার অভিযোগ ওঠে, সেগুলোর তদন্ত হয় এবং দোষী ব্যক্তিরা বিচারের মুখোমুখি হন। তাঁদের কীভাবে শনাক্ত করা হবে, কীভাবে তদন্ত করতে হবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের (আইসিজে) ‘প্র্যাকটিশনারস গাইড’, যা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। অর্থাৎ এখন এ ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে মনে করা হলে, কোনো এক পর্যায়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করা যায় এবং তাতে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থা সহযোগিতা করে থাকে।

প্রাসঙ্গিকভাবে বলা জরুরি যে চিলি, গুয়াতেমালাসহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেসব অপরাধ করেছে, তার প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন জুগিয়েছে বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) এসব ডেথ স্কোয়াডকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ এবং প্রমাণ আছে। কিন্তু গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যার কাজে প্রত্যক্ষভাবে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদেরই এখন বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ কথা বলার কারণ এটাই যে, যেকোনো দেশে গুমের মতো বেআইনি কাজ বিদেশিদের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে করলেও তার দায় সেই দেশের নাগরিকেরাই বহন করেন, বিদেশিরা তাঁদের রক্ষার কাজে এগিয়ে আসে না।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের সফর গুম এবং গোপন নির্যাতনকেন্দ্র থাকার এসব অভিযোগ বিষয়ে স্বচ্ছতার সুযোগ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে একটি স্বাধীন সংস্থা কীভাবে গঠন করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের দপ্তর তৈরি আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। সরকার চাইলে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, না গ্রহণ করার মধ্যে আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য একটা বার্তা আছে। সেটা ইতিবাচক নয়, তার প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক হবে না বলে অনুমান করা যায়।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট