‘সাধারণত ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পুরুষের সর্বনিম্ন ওজন থাকতে হয় অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর ওজন অন্তত ৪৫ কেজি। গড়ে চার মাস পরপর রক্ত দেওয়া যায়।’
‘সাধারণত ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পুরুষের সর্বনিম্ন ওজন থাকতে হয় অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর ওজন অন্তত ৪৫ কেজি। গড়ে চার মাস পরপর রক্ত দেওয়া যায়।’

দৃঢ় হোক রক্তের বন্ধন

রক্তদান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও নিঃস্বার্থ উপহার। রক্ত ছাড়া কোনো মানুষের জীবন কল্পনাও করা যায় না। প্রয়োজনে সময়মতো রক্ত সরবরাহ করা না হলে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে। রক্তের ঘাটতি পূরণ করে রক্তদানের মাধ্যমে জীবন বাঁচানো যায়। চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজে রক্তের প্রয়োজন হয়। যাঁরা জীবন-মরণ প্রশ্নে স্বেচ্ছায় রক্ত দান করছেন, তাঁদের উৎসাহ দেওয়ার নিমিত্তে পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।

প্রতিবছর ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালিত হয়। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো গোটা বিশ্বের মানুষকে রক্তদানের বিষয়ে সচেতন করে তোলা, উদ্বুদ্ধ করা, মানুষের মধ্যে সংহতি ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে রক্তদানের গুরুত্ব প্রচার, রক্তদানের ক্ষেত্রে অমূলক ভয় দূর করা, নতুন রক্তদাতা তৈরি করা এবং নিরাপদ রক্ত ব্যবহারে উৎসাহিত করা।

দিবসটি পালনের আরও একটি তাৎপর্য হলো ১৮৬৮ সালের এই দিনে জন্ম হয়েছিল নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের। তিনি ১৯৩০ সালে এবিও ব্লাড গ্রুপ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতে ১৪ জুন পালন করা হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ২০০৪ সালে দিবসটি প্রথম পালিত হয়। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়।

রক্তদান হলো কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া। উন্নত দেশে বেশির ভাগ রক্তদাতাই হলো স্বেচ্ছায় রক্তদাতা, যাঁরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রক্ত দান করে থাকেন। দরিদ্র দেশগুলোয় এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা খুবই কম। দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার মাত্র ৩১। বেশির ভাগ রক্তদাতাই কেবল তাঁদের পরিচিতজনদের প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে থাকেন। বেশির ভাগ রক্তদাতাই সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে রক্ত দেন, তবে কিছু আছেন পেশাদার রক্তদাতা।

সাধারণত ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পুরুষের সর্বনিম্ন ওজন থাকতে হয় অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর ওজন অন্তত ৪৫ কেজি। গড়ে চার মাস পরপর রক্ত দেওয়া যায়। রক্তদানে কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না। কেননা, দেহের ওজনের বিবেচনায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে গড়পড়তা ৫ লিটার রক্ত থাকে। প্রতিবার রক্তদান সেশনে ৫০০ মিলিলিটার করে রক্ত নেওয়া হয়। রক্তদানের ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নতুন রক্ত তৈরি হয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বের ৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়ে থাকেন। তবে উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার হাজারে ৪০ জন হলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে হাজারে ৪ জনেরও কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকে। কিন্তু রক্ত পাওয়া যায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ ব্যাগ। বাকি প্রায় ৩ লাখ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের জন্য প্রয়োজন দেশের জনগণকে সচেতন করা। হিসাবমতে, দেশে সরকারিভাবে ২২৩টি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে।

রক্তদান সামাজিক সংহতির কাজ। নিয়মিত রক্তদান নিঃসন্দেহে একটি ভালো অভ্যাস। রক্তদান কোনো দুঃসাহসিক বা স্বাস্থ্যঝুঁকির কাজ নয়; বরং এর জন্য একটি সুন্দর মন থাকাই যথেষ্ট। রক্তদাতার শরীরের কোনো ক্ষতি তো হয়ই না, বরং নিয়মিত রক্ত দিলে বেশ কিছু উপকারও পাওয়া যায়। নিয়মিত রক্তদানে হৃদ্‌রোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা বছরে দুবার রক্ত দেন, অন্যদের তুলনায় তাঁদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।

সম্প্রতি ইংল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রক্তদান ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যানসারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিলক্ষিত হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা নীরবে তাঁদের শরীরের রক্ত দান করে যান। রক্তদানের সময় তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জানেনও না, এ রক্ত কোন মানুষের শরীরে বইবে। একইভাবে রোগীদের কাছেও অচেনা থেকে যান রক্তদাতারা।

মানবিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে রক্তদাতা অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন। সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদাও পান না তেমন একটা। গ্রহীতা আর তাঁর পরিবার চিরদিন ঋণী থাকেন জীবন বাঁচানোর জন্য। দাতার জন্য এটা যে কী আনন্দের, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। আবার ধর্মীয় দিক থেকে রক্তদান অত্যন্ত পুণ্যের বা সওয়াবের একটি কাজ। রক্তদানকারীরা খুবই ভাগ্যবান। দুনিয়াতেও তাঁদের উপকার, আখিরাতেও তাদের উপকার। দুনিয়ার উপকারটা দুই ধরনের। একটি হলো ব্যক্তিগত উপকার আর অন্যটি হলো অন্যের উপকার।

ব্যক্তিগত উপকারের কথা বলা হলে বলতে হবে যে রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সব দৃষ্টিকোণ থেকেই রক্তদাতা অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদাও পান। গ্রহীতা আর তাঁর পরিবার চিরদিন ঋণী থাকেন তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য। বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্ক হলো রক্তের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক কখনো ছিন্ন করা যায় না। তাই রক্তদান মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। এতে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি পায়।

রক্তদান আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে। এটা সম্পূর্ণ মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক কার্যক্রম। এর মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়, এমনকি ধর্মীয় সম্প্রীতিও বৃদ্ধি পায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার রক্তই লাল। এর মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এই মহতী কাজে সমাজের নানা পেশা-শ্রেণির মানুষকে সম্পৃক্ত করা দরকার। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে তা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবসে তরুণ প্রজন্মকে রক্তদানে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্বাধীনতা দিবসে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রক্ত দান করে থাকেন। তাঁদের যুক্তি হলো, তাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেননি, তবে শুনেছেন, সে যুদ্ধে অনেক মানুষ প্রাণ বা রক্ত দিয়েছেন। তাঁদের সম্মানে তাঁরা রক্ত দান করে থাকেন।

এটি নিঃসন্দেহে একটি মহৎ উদ্যোগ। দেশের প্রায় সব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তদানের সংগঠন আছে, যারা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে রক্ত সংগ্রহ করে থাকে। যেমন ‘একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন’ স্লোগানে শিক্ষার্থীদের পরিচালিত বাঁধন নামে সংগঠনটি ২৫ বছর ধরে স্বেচ্ছায় রক্তদানকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছে। মানুষ হিসেবে মানুষের উচিত অন্যের সেবায় এগিয়ে আসা। এ প্রসঙ্গে সমাজচিন্তক অগাস্ট কোঁত বলেছেন, ‘অন্যের জন্য বাঁচো।’

আপনার দেওয়া এক ব্যাগ রক্ত যদি একটি জীবন বাঁচাতে পারে, তবে অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে রক্তদানে এগিয়ে আসা উচিত। দেশে রক্তের চাহিদা পূরণে রক্তদাতা বৃদ্ধি করা দরকার। কীভাবে আহ্বান জানালে রক্তদাতা বৃদ্ধি হবে, তা নিয়ে প্রয়োজনে সামাজিক গবেষণা চালাতে হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে এর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। তাহলেই সবার মধ্যে রক্তদানের আকুলতা সৃষ্টি হবে। তাই সবার রক্তদানে অভ্যস্ত হওয়া উচিত।

অন্তত এক ব্যাগ রক্তদান করি সেই থ্যালাসেমিয়া-যোদ্ধাদের জন্য, যাঁদের রক্তদানে তাঁরা প্রাণভরে নিশ্বাস নেবেন। আপনার এক ব্যাগ রক্তে বাঁচবে হাজারো প্রাণ, বাঁচবেন থ্যালাসেমিয়া-যোদ্ধারা। আসুন আমরা সবাই নিয়মিত রক্তদান করি এবং নতুনদের রক্তদানে আগ্রহী করে তুলি।

  • খ ম রেজাউল করিম শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।