রাহুল গান্ধী কবে বুঝবেন ফলন্ত গাছ ঝুঁকে থাকে

রাহুল এত দিন ধরে যে ঢংয়ে ও ভাষায় নরেন্দ্র মোদির ‘নতুন ভারতের’ সমালোচনা করেছেন, ব্রিটেনেও তারই পুনরাবৃত্তি শোনা গেল।
ছবি : রয়টার্স

রাহুল গান্ধী কি তাঁর অজান্তেই বিজেপির হাতে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিলেন? ভারত জোড়ো যাত্রার সাফল্যের পর তাঁর সাম্প্রতিক বিলেত সফর এই প্রশ্নটি বড় করে তুলে ধরেছে।

ভারত জোড়ো যাত্রা বিজেপিকে বেশ খানিকটা কোণঠাসা করেছিল। যাত্রা শুরুর আগে তারা যতটা আক্রমণাত্মক ছিল, যেভাবে প্রতি পদে রাহুলের সমালোচনা করত, যাত্রার অগ্রগতির সঙ্গে তা স্তিমিত হয়ে যায়।

কর্ণাটক পেরিয়ে যাত্রা মধ্য ভারতে পৌঁছানোর পর আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় কংগ্রেস ও রাহুল সম্পর্কে বিজেপি নির্বাক! সেই প্রথম বিজেপিকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। নেতা হিসেবে রাহুলের রূপান্তর নিভৃতে স্বীকারও করছিল। আক্রমণ ভুলে রক্ষণে মন দিয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেসও ঘোষণা করেছিল তাদের ভারত জোড়ো যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব।

অথচ তার আগেই ছন্দপতন। আর সেই ছন্দপতনের কারিগর খোদ রাহুল কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর চর্চা।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাহুলের ভাষণ দিতে যাওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার সময় পর্যন্ত বিজেপি চুপ ছিল। কিন্তু নিজের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ভাষণ, তার পর অন্যান্য সব অনুষ্ঠানে রাহুল যা যা বললেন, নতুন অস্ত্র হিসেবে বিজেপি তা সানন্দে গ্রহণ করেছে। সর্বস্তরে প্রচার শুরু হয়েছে, রাহুল বিদেশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর অসম্মানই শুধু করেননি, দেশের উঁচু মাথাও হেঁট করে দিয়েছেন। গণতন্ত্র, সংসদ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তো বটেই, গোটা দেশের সম্মান ধুলোয় মিশিয়েছেন। এমনকি পরিস্থিতির মোকাবিলায় পশ্চিমা দুনিয়ার হস্তক্ষেপও দাবি করেছেন।

হিনডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে বিজেপি ভারতবিরোধিতার একটা তত্ত্ব বড়ভাবে মেলে ধরেছে। বিবিসির তথ্যচিত্র তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই চক্রান্ত তত্ত্বের সঙ্গে বিজেপি নিপুণভাবে মিলিয়ে দিয়েছে রাহুলকেও। প্রবলভাবে প্রচার চলছে, দেশকে দুর্বল করতে তিনি দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এই কারণে তাঁর লোকসভার সদস্য পদ খারিজের দাবি উঠেছে। কংগ্রেসই তুলে দিয়েছে সেই হাতিয়ার। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিদেশে প্রচারাভিযানের অপরাধে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন জনসংঘের রাজ্যসভা সদস্য সুব্রামানিয়াম স্বামীর সদস্য পদ খারিজ করা হয়েছিল। একই ‘অপরাধে’ দাবি উঠেছে রাহুলের সদস্য পদ খারিজের।

আদর্শের রাজনীতি ও প্রকৃত রাজনীতির পার্থক্য কী ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে বিজেপি তা বুঝিয়ে দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দলের খ্রিষ্টান নেতারা বুক বাজিয়ে গরুর মাংস ‘খাচ্ছি-খাব’ বললেও হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাক থেকেছে। দুর্নীতির দায়ে মেঘালয়ের শাসক দলকে তুলাধোনা করেও ফল বেরোনোর পর সব ভুলে হাত মিলিয়ে সরকারের শরিক হয়েছে। ক্ষমতালাভ ও টিকে থাকার এই তাগিদ কংগ্রেসে এখনো অদৃশ্য! জোটের কথা মুখে বললেও সমভাবাপন্ন দলের জোট তৈরিতে রাহুল তো বটেই, গোটা কংগ্রেস এখনো দ্বিধান্বিত!

রাজনীতিতে ‘ন্যারেটিভ’ বা আখ্যান তৈরি গুরুত্বপূর্ণ। আখ্যান জন্ম দেয় ধারণার। অনেক বছর পর ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্য দিয়ে বিকল্প রাজনীতির এক আখ্যান তৈরিতে সফল হয়েছিল কংগ্রেস। রাহুলের বিলেত সফর বিজেপিকে পাল্টা আখ্যান তৈরির সুযোগ ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’র মতো হাতে তুলে দিল কি না, শুরু হয়েছে সেই চর্চা। এর মোকাবিলা কংগ্রেস কতটা করতে পারবে, সেই জল্পনায় না গিয়ে বলা যায়, তিলকে তাল কিংবা তালকে তিল করার ক্ষমতা বিজেপির যতটা, তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও এই মুহূর্তে ভারতের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।

রাহুল এত দিন ধরে যে ঢংয়ে ও ভাষায় নরেন্দ্র মোদির ‘নতুন ভারতের’ সমালোচনা করেছেন, ব্রিটেনেও তারই পুনরাবৃত্তি শোনা গেল। যেমন দেশে গণতন্ত্র নেই, গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান আরএসএসের দখলে, মিডিয়া বিক্রি হয়ে গেছে, সরকারি তদন্ত সংস্থার একমাত্র লক্ষ্য বিরোধীরা, অর্থনীতি বিপন্ন, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের রমরমা, দেশজুড়ে বেকারত্বের তীব্র জ্বালা, চূড়ান্ত ধর্মীয় মেরুকরণ, সমাজ বিভাজিত, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে ইত্যাদি। ভারত জোড়ো যাত্রার সময়ও রাহুল এসবই বলেছিলেন। সেই সঙ্গে বুঝিয়েছিলেন কেন এর বিরুদ্ধে সবার রুখে দাঁড়ানো দরকার। যাত্রা চলাকালীন দুটি রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়।

হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাট। যাত্রা শেষে ভোট হয় ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে। হিমাচল প্রদেশ ছাড়া বাকি চার রাজ্যে কংগ্রেসের চিত্র করুণ। গুজরাট ও মেঘালয়ে নামকাওয়াস্তে প্রচার ছাড়া রাহুল কেন কোথাও গেলেন না? কেন দেখা গেল না প্রচারের জোয়াল নিজের কাঁধে তুলে নিতে? প্রধানমন্ত্রী মোদি তো এই ঢিলেমি দেন না? ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি তো প্রতিটি রাজ্যে একাধিকবার প্রচারে গিয়েছেন? এর কোনো জুতসই ব্যাখ্যা রাহুল আজও দিতে পারেননি।

সেখান থেকেই জন্ম পরবর্তী প্রশ্নের। বিজেপির বিজয় রথ আটকাতে রাহুল ও কংগ্রেসের ভূমিকা কী? কোন বাড়তি উদ্যোগ তারা নিয়েছে সবাইকে একজোট করতে? কোনো জবাব এখনো রাহুলের কাছে নেই। কারণ, সবাইকে কাছে টানার কোনো মন্ত্র এখনো তিনি উচ্চারণ করতে পারেননি।

আদর্শের রাজনীতি ও প্রকৃত রাজনীতির পার্থক্য কী ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে বিজেপি তা বুঝিয়ে দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দলের খ্রিষ্টান নেতারা বুক বাজিয়ে গরুর মাংস ‘খাচ্ছি-খাব’ বললেও হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাক থেকেছে। দুর্নীতির দায়ে মেঘালয়ের শাসক দলকে তুলাধোনা করেও ফল বেরোনোর পর সব ভুলে হাত মিলিয়ে সরকারের শরিক হয়েছে। ক্ষমতালাভ ও টিকে থাকার এই তাগিদ কংগ্রেসে এখনো অদৃশ্য! জোটের কথা মুখে বললেও সমভাবাপন্ন দলের জোট তৈরিতে রাহুল তো বটেই, গোটা কংগ্রেস এখনো দ্বিধান্বিত!

বিজেপি কিন্তু সুযোগ দিয়েই চলেছে। একের পর এক ‘দুর্বিনীত’ বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দিচ্ছে। যাকে খুশি যখন খুশি গ্রেপ্তার করছে। এই পরিস্থিতিতে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সব ভুলে সবাইকে জোটবদ্ধতায় শামিল করা যেখানে সময়ের দাবি, কংগ্রেস সেখানে কার বিজেপি বিরোধিতায় কতটা খাদ, কে কার ‘বি টিম’, সেই বিচারে ব্যস্ত।

ভোটের রাজনীতিতে ভোটে জেতাই সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি। রাহুল না পারছেন দলকে ভোটে জেতাতে, না পারছেন বিরোধীদের একজোট করতে। কর্ণাটকে সরকার গড়ে রাজস্থান ও ছত্তিশগড় ধরে রেখে মধ্যপ্রদেশ ছিনিয়ে নেওয়ার খোয়াব দেখতে দেখতে তিনি ভাবছেন ২০২৪–এ কেল্লাফতে করবেন।

তাঁর বোঝা উচিত, মোদির নতুন ভারতের রাজনীতি সরলরেখায় চলে না। লোকসভার সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হলে দেশ উত্তাল করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাহুল বা কংগ্রেসের নেই। সেটা হতে পারত সব ভুলে জোটবদ্ধ হতে পারলে। কিন্তু মাথা তিনি নোয়াবেন না। রাহুলের জানা উচিত, ফলন্ত গাছ ঝুঁকে থাকে।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি