জ্যঁ লুক মেলেনচন
জ্যঁ লুক মেলেনচন

মতামত

নতুন ফ্রান্সের লড়াই সবে শুরু, সামনে কী অপেক্ষা করছে

বামপন্থী দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‍্যালির (আরএস) ভূমিধস বিজয় তারা ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে।

সোশ্যালিস্ট, গ্রিনস, কমিউনিস্টস ও জ্যঁ লুক মেলেনচনের ফ্রান্স আনবোড দলের মধ্যে অতীতে গভীর বিভক্তি ছিল। সেই বিভক্তি মিটিয়ে একটি জোট করা খুব একটা সহজ ছিল না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থী জোটটির রোববারের বিজয় ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। গত মাসে এনএফপি জোট গঠনের পর থেকে তারা মধ্যপন্থী অভিজাত ও উগ্র ডান—দুই শিবিরের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল।

দুই পক্ষই বামপন্থীদের জোটকে ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের জন্য ভবিষ্যৎ বিপদ বলে আক্রমণ শাণিয়েছিল।

সংবাদমাধ্যমের পরিবেশও ছিল এনএফপির জন্য চূড়ান্ত রকম বৈরী। ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যমে খুব অসম্মানজনকভাবে বলতে চেয়েছে অতি ডান ও অতি বাম দুই শিবিরই রাজনৈতিকভাবে খুব কাছাকাছি।

মেরি লো পেন এবং ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টির প্রেসিডেন্ট জরদান বারদেলা গত কয়েক সপ্তাহের নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁদের দলকে নতুন ‘মধ্যডানপন্থী’ দল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা এনএফপিকে প্রকৃত ‘চরমপন্থী’ হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছেন।

বামপন্থী জোটকে বিশেষ করে জ্যঁ লুক মেলেনচনকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে তাঁরা অ্যান্টিসেমেটিক বা ইহুদিবিদ্বেষী তকমা দেন তাঁরা।

অথচ ন্যাশনাল র‍্যালি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন একজন দাগি অপরাধীর হাত ধরে, যিনি ছিলেন হলোকাস্ট অস্বীকারকারী।

আরএনের বর্ণবাদী ঐতিহ্যকে চুনকাম করার এবং এনএফপিকে অ্যান্টিসেমেটিক হিসেবে তুলে ধরার কাজ এতটাই জোরালোভাবে করা হয়েছে যে ৩০ জুন প্রথম দফা নির্বাচনের পর গণমাধ্যম বলতে শুরু করে বামপন্থীদের বিজয় হলে, সেটা ফ্রান্সের জন্য ক্ষতিকর হবে; বামপন্থীরা আসার চেয়ে উগ্র ডানপন্থী কারও আসা ভালো।

মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কিছু ডানঘেঁষা কর্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে মধ্যপন্থা ও ডানপন্থার মধ্যকার ভেদরেখাটা হাপিশ করে দিয়েছিলেন।

ফলে মূলধারার দল হিসেবে পার্লামেন্টে ন্যাশনাল র‍্যালির পুনর্বাসনের শর্ত প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। মনে হতে শুরু হয়েছিল, ডানপন্থী দলটি অবশেষে ফ্রান্সের পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে।

জরিপে আরএনের পরিষ্কার বিজয়ের পূর্বাভাস সত্ত্বেও ফ্রান্সের ভোটাররা রোববার লো পেনের কট্টর ডানপন্থী আরএনকে প্রত্যাখ্যান করেন।

এনএফপি জোট ১৮২টি আসন পেয়ে প্রথম হয়। মাখোঁর মধ্যপন্থী ও নয়া উদারবাদীদের জোট ১৬৩টি পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। লো পেন ও বরদেলার আরএন মাত্র ১৪৩টি আসন পেয়েছে। তাদের সামনে সরকার গঠনের কোনো বাস্তব পথ নেই।

রোববার মেলেনচন ও তাঁর নতুন মিত্ররা ফ্রান্সজুড়ে যে বিজয় পেয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে স্মরণীয় বিজয়। তাঁরা দেখিয়েছেন যে বামেদের এবং অর্থপূর্ণ সংস্কার ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রশ্নে তাদের নাছোড় দাবির বিজয় হয়েছে।

তাঁরা দেখিয়েছেন, মধ্যপন্থীদের নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত উগ্র ডানপন্থীদের যে উত্থান তৈরি করেছিল, তার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে বামপন্থীদের অ্যাজেন্ডা।

যাহোক, এখনই তাদের বিজয় উদ্‌যাপন করা অকালবোধনের মতো ঘটনা হয়ে যাবে।

কেননা আরএন পার্লামেন্টে ১৪৩-টি আসন নিশ্চিত করেছে। বাম জোট যতটা আসন পেয়েছে, তা দিয়ে নিজেরা একা সরকার গঠন করতে পারবে না।

এর মানে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হতে যাচ্ছে। আরএন পার্লামেন্টে নিশ্চিতভাবে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে থাকবে। এটা বিশ্বাস করার সব কটি কারণ আছে যে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোয় আরএন আরও শক্তি নিয়ে লড়াই করবে।

এসব সত্ত্বেও বাম জোট এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও হারানো সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সের ভোটাররা এটা স্পষ্ট করেছেন যে তারা মাখোঁর মধ্যপন্থা ও মতাদর্শগত অস্পষ্ট শাসনে ক্লান্ত।

অর্থনীতিকে ঠিক পথে আনতে মাখোঁও ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর কর্তৃত্ববাদী নীতি উগ্র ডানপন্থাকে স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত করেছে। তার ফলে ফ্রান্সের অনেক ভোটার আরএনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এখন ভোটাররা আরএনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে বাম জোটের সামনে তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের বাস্তব একটা সুযোগ এসেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে নতুন একটা ফ্রান্সের পথ তৈরির সুযোগ তাদের সামনে এসেছে।

পরিবেশের যত্ন এবং ফ্রান্সের জনগণের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে এমন একটা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সুযোগ তাদের সামনে এসেছে।

এনএফপি জোট যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার মধ্যে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, অবসরের সময় ৬৪ বছর থেকে কমিয়ে ৬০ করা, পাঁচ পাঁচ বছরের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ১০ লাখ গৃহনির্মাণ এবং খাদ্য, জ্বালানি ও গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা।

জোটটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিশুদের সব শিক্ষাব্যয় (খাদ্য, পরিবহন ও কারিকুলামবহির্ভূত শিক্ষা কার্যক্রম) রাষ্ট্র নির্বাহ করবে। আর এ ব্যয়ভার নির্বাহ করা হবে ধনীদের ওপর আরও কর বসিয়ে।

বামপন্থী জোট ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে।

এসব উচ্চাভিলাষী অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়ন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। তারা অতি ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি পাল্টা শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হতে পারে।

তারা এমন একটা দেশে বামপন্থী ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ দেখাতে পারে যে দেশটিকে খুব জরুরিভাবে মাখোঁর নয়া উদারপন্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

  • জর্জিওস সামারাস কিংস কলেজ লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ফর গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিসি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত