সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা আন্তনগর ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে মারা হয়
সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা আন্তনগর ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে মারা হয়

মতামত

ট্রেনযাত্রীকে রক্তাক্ত করে কি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ পাওয়া যায়

এ দেশে দাবিদাওয়া আন্দোলনে সড়ক আটকাতে হবে, এটিই যেন রেওয়াজ। সড়ক আটকানো ছাড়াও আন্দোলন হয়, সেই আন্দোলনের দাবি–দাওয়াকে গুরুত্বও দিতে হয়—তা আমাদের এখানে অনুপস্থিত। ঢাকা শহরের মতো জনবহুল ও ব্যস্ততম শহর আচমকা দাবিদাওয়ার আন্দোলনে গোটা দিন অচল হয়ে থেকেছে, এ রকম বহু উদাহরণ আছে।

গত তিন মাসে ঢাকা শহরের সবচেয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে—রাষ্ট্র সংস্কার। তবে সেটিও ছাপিয়ে গিয়ে ঢাকাকে এখন দাবি আদায়ের আন্দোলনের শহর বললে ভুল হবে না। প্রতিদিন একেক দল বা গোষ্ঠী বা পক্ষ রাস্তায় নেমে আসছে আর নিজেদের বিবিধ দাবি জানাচ্ছে। বরাবরের মতোই সেই এলাকা অচল হয়ে পড়ছে এবং তার পুরো প্রভাব পড়ছে গোটা ঢাকা শহরে। একেকটা দিন অচল হয়ে থাকায় যে কর্মঘণ্টার অপচয় হচ্ছে, তার অর্থমূল্য অপরিসীম।

আজকেও পুরো ঢাকা দুপুরের আগ থেকে বিকেল পর্যন্ত অচল হয়ে গিয়েছিল সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। তাঁদের দাবি হচ্ছে, কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এখন তাঁদের এ দাবি কতটা যৌক্তিক বা আদৌ যৌক্তিক কী না সেই আলোচনায় পড়ে আসছি।

তিতুমীর কলেজের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে কয়েকটি সড়ক অবরোধ করেন। তাঁরা শুধু সড়ক অবরোধ করলে না হয় মানা যেত, যেহেতু এটিই এ দেশের রেওয়াজ! কিন্তু তাঁরা ওই এলাকার রেলপথও অবরোধ করলেন।

রেলপথ অবরোধের ঘোষণা কি তাঁরা আগেই দিয়েছিলেন? এমন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে থাকলেও সেটির প্রচারণা কি তাঁরা যথাযথভাবে চালিয়েছিলেন? সেটি না হয়ে থাকলে ওই পথ দিয়ে চলন্ত ট্রেনের তো জানার কথা নয় সেই রেলপথ অবরোধের বিষয়টি। ফলে যা হওয়ার তা–ই হলো—রেলপথ দিয়ে ট্রেন ছুটে চলল।

রেলপথের ওপর থাকা অবরোধকারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ট্রেনের গতিও কমালেন চালক। এরপরেও অবরোধকারীরা সেই ট্রেন থামাতে যা করলেন, তা খুবই ভয়াবহ।
রেলপথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ট্রেন বরাবর পাথর ছোড়া শুরু করলেন কিছু বিক্ষোভকারী।

আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার দাবিদার এসব আন্দোলনকারী কীভাবে ভাবলেন, এভাবে পাথর ছুড়ে ট্রেন থামানো যায়! আচমকা ট্রেন থামানোর যে সুযোগ নেই, সেটি নিশ্চয়ই তাঁদের না জানার কথা নয়। আর ট্রেনে পাথর মারলে কী হয়, সেটিও নিশ্চয়ই তাঁদের না জানার কথা নয়। ফলে তাঁদের ছোড়া পাথরের আঘাতে ট্রেনের বেশ কয়েকটি জানালার কাচ ভাঙল। শুধু তা–ই নয় সেই পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে কয়েকজন যাত্রীও।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছোড়া পাথরে রক্তাক্ত নারী–শিশুসহ একাধিক ট্রেনযাত্রী।

রক্তাক্ত যাত্রীদের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। নারী ও শিশুর চোখ-মুখ রক্তে ভরে গেছে। যাত্রাপথে এমন নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার শিকার হতে হলো তাদের। তিতুমীর কলেজের আন্দোলনকারী কতিপয় শিক্ষার্থী দাবি আদায়ের কর্মসূচির নামে যা করলেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। পাথর ছোড়ার সময় এতগুলো শিক্ষার্থী একবারও ভাবলেন না যাত্রীদের কথা। এটি কি ব্যাঙকে মাথর ছুড়ে মেরে আনন্দ পাওয়ার খেলা!

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকে বারবার বলে আসছে যে কোনো দাবি থাকলে তাদের কাছে যেতে। তাদের কাছে আবেদন জানালে তা নিয়ে তারা আলোচনা করবে, বিবেচনা করে দেখবে।

কিন্তু আমরা দেখলাম কী, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি জানাতে সরকারের কাছেই যেতে রাজি নন। বরং সরকারের প্রতিনিধিকে তাঁদের কাছেই আসতে হবে বলেও দাবি জুড়ে দিলেন। সরকারের প্রতিনিধি এসে তাঁদের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গেই আলোচনায় বসতে হবে, তার আগপর্যন্ত অবরোধ চলতে থাকবে।

এ কেমন কথা! তাঁরা কি আসলে তাঁদের দাবি আদায় করতে চান? এরপর শহরজুড়ে চরম অচলাবস্থা তৈরি হলে তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল ঠিকই সচিবালয়ে গেল আলোচনা করতে। সেটিই কেন তাঁরা শুরুতে করলেন না? কেন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আটকে দিয়ে মানুষের চরম ভোগান্তি তৈরি করলেন, কেন পাথর মেরে নারী ও শিশু ট্রেনযাত্রীকে রক্তাক্ত করলেন?

এর আগে আমরা দেখেছি, সাত কলেজকে নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। তার মধ্যে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছিলেন। তাঁদের টানা কয়েক দিন আন্দোলনেও ঢাকা শহরের একাংশ অচল হয়ে পড়েছিল।

তখন এক বিবৃতিতে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা খাতের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের দাবি পূরণের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে এবং এর জন্য তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া কঠিন। অথচ আন্দোলনকারীরা তাঁদের দাবিকেই সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে শুধু রাস্তায় আন্দোলন করে তাৎক্ষণিক সমাধানযোগ্য মনে করছেন। এতে একদিকে যেমন রাস্তা অবরোধের ফলে অপরিসীম জনদুর্ভোগ হচ্ছে; সরকারও দাবিগুলো যথাযথ বিবেচনার সুযোগ পাচ্ছে না।

এখন সাত কলেজের প্রতিটি কলেজই কি তাহলে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামবে? কালকে কি আমরা দেখব ইডেন কলেজের ছাত্রীরাও নীলক্ষেতের রাস্তায় নেমে এসেছে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে? পরের দিন মিরপুরের রাস্তা অবরোধ করতে নেমে এসেছে সরকারি বাঙলা কলেজ? এভাবে অন্য কলেজগুলোও? এভাবে চলতে থাকলে তো দেশের এ-মাথা ও-মাথার জেলা-উপজেলার সব কলেজই নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা শুরু করবে!

তিনি আরও বলেন, সমস্যাটির শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে ঢাকার সাতটি কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতা থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করার একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের উভয় পক্ষেরই সমস্যা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ওই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা অসুবিধা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। এগুলোর সুষ্ঠু সমাধান কী হতে পারে, তা বিবেচনায় ন্যূনতম কিছু সময়ের প্রয়োজন।

ইতিমধ্যে সাত কলেজের সমস্যা নিয়ে সরকার একটি কমিটি করেছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে। তার মানে এটি স্পষ্ট, সরকার তাদের সমস্যার সমাধানের বিষয়ে কাজ করছে। সেটির অগ্রগতি কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, প্রয়োজনে আরও আলোচনা হতে পারে উভয় পক্ষের মধ্যে।

কিন্তু একটি চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে সাত কলেজেরই একটি কলেজ কীভাবে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে? এটি কি তাদের অবিবেচক বা ভুল সিদ্ধান্ত নাকি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়েই সেটি করলেন?

এখন সাত কলেজের প্রতিটি কলেজই কি তাহলে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামবে? কালকে কি আমরা দেখব ইডেন কলেজের ছাত্রীরাও নীলক্ষেতের রাস্তায় নেমে এসেছে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে? পরের দিন মিরপুরের রাস্তা অবরোধ করতে নেমে এসেছে সরকারি বাঙলা কলেজ? এভাবে অন্য কলেজগুলোও? এভাবে চলতে থাকলে তো দেশের এ-মাথা ও-মাথার জেলা-উপজেলার সব কলেজই নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা শুরু করবে!

তিতুমীর কলেজ বা সাত কলেজ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ, সেটি মেনে নিয়েই তো শিক্ষার্থীরা সেখানে ভর্তি হয়েছেন। এখন অধিভুক্ত হওয়ার কারণে নানা জটিলতা ও সমস্যা তৈরি হয়েছে। নানাভাবে সেগুলো সমস্যার সমাধান হতে পারে, সে অনুসারে আলোচনা ও পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর জন্য আছে স্ব স্ব কলেজ কর্তৃপক্ষ, আছে শিক্ষকবৃন্দ, আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শুরুতে কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গেই কোনো আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি দাবি আদায়ের জন্য সরকারকে বাধ্য করাও কতটা যৌক্তিক, সেই প্রশ্নও চলে আসে।

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলেজ থাকবে কী না, বিশ্ববিদ্যালয় হবে অর্থাৎ এর ‘স্ট্যাটাস’ কী হবে, সেটি কি শিক্ষার্থীদের নির্ধারণ করার কথা? একটি কলেজের ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হওয়ার কী কী যোগ্যতা বা সামর্থ্য আছে সেটিও তো গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচনার বিষয়।

এখন সাত কলেজকে বা প্রতিটি কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করে ফেললে তাঁদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা কী করে নিশ্চিত হলেন তাঁরা? জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর যে ‘উচ্চশিক্ষার মেকি উন্নয়ন’ দেখানো হলো, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কী হাল তাঁরা কি তা জানেন না? তাঁরা কী করে ভাবলেন সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করলে, ট্রেনে পাথর ছুড়লে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা চলে আসবে?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই-মেইল: rafsangalib1990@gmail.com