মতামত

যেভাবে গণভবনে: ‘কামিং কামিং, রাইটার জার্মানি’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন’, সঙ্গে লেখক সরাফ আহমেদ। গণভবন, ঢাকা
ছবি সৌজন্য: এস এম গোর্কি

গেট পেরোতেই গাড়ি থামল। ডান দিকে গার্ডরুম। নাম বললাম। তাঁরা কী সব বলাবলি করছিলেন ওয়াকিটকিতে। কানে ভেসে এল ‘সরাফ আহমেদ রাইটার জার্মানি’।

গাড়িটি তল্লাশি করে বলা হলো, ভেতরে যাবে না, গ্যাস সিলিন্ডারের গাড়ি। প্রহরীরা বললেন, ‘আমাদের গাড়ি আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাবে।’ নাম ও ফোন নম্বর লিখে দিলাম। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বইগুলো স্ক্যান করা হলো।

বললাম, ‘আচ্ছা, গাড়িতে না গিয়ে আমি কি হেঁটে যেতে পারি?’ বলা হলো, কেউ তা করে না, তবে হেঁটেও যেতে পারেন। সামনে আরও দুটি তল্লাশিচৌকি (চেকপোস্ট)। শুধু নাম বলবেন।

পরের তল্লাশিচৌকিকে ওয়াকিটকি দিয়ে জানানো হলো, ‘কামিং কামিং, রাইটার জার্মানি।’ বহু বছর ধরে লেখালেখি করি। কিন্তু কস্মিনকালে এই সম্বোধন শুনিনি।

আগের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলা থেকে প্রথম আলো অফিসে যাই। জার্মানিতে ফেরার আগে সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতেই উনি আমাকে ১২তলায় যেতে বললেন। সেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছি।

হঠাৎ একটা ফোন। বলা হলো আমি যেন দ্রুত করোনা র‍্যাপিড টেস্ট করি, কাল (৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ। রাত তখন নয়টা। ভাবি, এত রাতে কোথায় র‍্যাপিড টেস্ট করাব। সহকর্মীদের সহযোগিতায় দ্রুত রাতেই শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে টেস্ট করাই।

আশঙ্কায় সময় কাটে, আবার যেন করোনা পজিটিভ না হয়। ২০২২ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন ঠিক হলেও করোনা পজিটিভ হওয়ায় সাক্ষাৎটি বাতিল হয়। যা–ই হোক, এবার করোনা টেস্ট নেগেটিভ। অবশেষে গণভবন যাচ্ছি।

আমি কোনো বাঘা সাংবাদিক নই। লেখকও নই। তবু শেষ অবধি লেখক হিসেবে এই সম্মান এক বড় প্রাপ্তি। ইতিহাসের চরিত্র যখন হন কোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, তখন বাইরে থেকে একজন গবেষক বা লেখকের সেখানে পৌঁছানো যেমন কঠিন, তেমনি পৌঁছাতে পারলেও তা হয়ে যেতে পারে ফরমায়েশি রচনা। তাই অজানা গুরুত্বপূর্ণ সংগৃহীত তথ্য নিয়ে এই বই রচনার সময় খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সহযোগিতা করেছিলেন মতি ভাইসহ (প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান) প্রথমা প্রকাশনের সম্পাদনা টিম।

এরপর পাতা ওল্টাতে থাকলেন, আর প্রশ্ন করছেন, ‘তুমি এত বছর পর কীভাবে এত মানুষকে খুঁজে বের করলে?’ আমি বলতে থাকলাম। তিনি চলে গেলেন দুঃসময়ের স্মৃতিতে। বললেন, ‘জানো, ওই দিনগুলিতে আমরা কী খেতাম আর কীভাবে যে সময়গুলি কাটত!’

এই গণভবন বাংলাদেশের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। আমার ইচ্ছা ভেতরটা যতটুকু সম্ভব হাঁটাপথে দেখা। আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর পরবর্তী প্রহরীচৌকি। আমার ছোট ব্যাগটা খুলতে বলা হলো। কাগজের প্যাকেটে রাখা চারটি বই নেড়েচেড়ে দেখা হলো।

আবার হেঁটে হেঁটে এগোতে থাকি। ডান দিকে অনেকটা আবাদি জমির মতো। মাঝারি ধরনের সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। মাঠে কিছু মোরগ চরে বেড়াচ্ছে।

মালিগোছের একজন জিজ্ঞাসা করেন, ‘ওদিকে হেঁটে কই যান?’ বলি, আমার অ্যাপয়েনমেন্ট আছে। আরেকটু এগিয়ে ডান দিকে বিশাল শামিয়ানা টানানো মঞ্চ। সামনে কোনো বাড়ি চোখে পড়ল না।

একজন প্রহরীকে বললাম, প্রধানমন্ত্রীর বাড়িটা কোন দিকে? প্রহরীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘বাড়িতে যাবেন, না শামিয়ানা টানানো এলাকায় মিটিংয়ে?’ বলি, বাড়িতে। আমাকে গাছপালাঘেরা বাড়িটির রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।

লাল ইটের দক্ষিণমুখী বাড়িটিতে প্রবেশ করে পরিচয় দিলাম। ডান দিকে রাখা স্ক্যানারে আমার সঙ্গে থাকা ছোট ব্যাগ ও বইগুলো স্ক্যান করা হলো। মুঠোফোন জমা রেখে একটি টোকেন দিয়ে ভেতরে বসতে বলা হলো। ওভাল সাইজের লম্বা বড় ঘরটির চারদিকে সোফার সারি। ঘরটির একদিকে প্রশস্ত করিডর, করিডরের দুই দিকে কর্মকর্তাদের অফিসকক্ষ, অন্যদিকে আরেকটি প্রশস্ত বড় বসার ঘর।

ওভাল সাইজের বড় ঘরটিতে সাক্ষাতের অপেক্ষায় বসে আছেন নানা পরিচয়ের বিশিষ্টজনেরা। সবার সঙ্গে কেউ না কেউ আছেন। আমি একাই একটি সোফায় চুপচাপ বসি। হঠাৎ মনে হলো আমার পোশাক যেন বেমানান। কোট-টাই কিছুই নেই। কালো খদ্দরের ফতুয়া, পরনে জিনসের প্যান্ট। আর কেডস। সবাই কেমন যেন আড়চোখে দেখছেন।

ওভাল সাইজের অপেক্ষাকক্ষে মাঝেমধ্যে চা–বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। ঘরটির মাঝে ডায়াসের ওপর একটি নৌকা। সামনের দেয়ালে দুটি বড় ছবি টাঙানো। একটি বঙ্গবন্ধুর, অপরটি শিল্পী শাহাবুদ্দিনের একটি নৌকার একাংশের ছবি।

ঘর আস্তে আস্তে খালি হতে থাকে। ঘরটিতে এসে ভিড় করেন প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল স্টাফ আর দেহরক্ষীরা। আমার মনে হতে থাকে, উনি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বেন বলে সবাই এখানে জড়ো হচ্ছেন।

হঠাৎ ভেতর থেকে একজন এসে আমার নাম ধরে ডাকেন। আমি ভেতরে যাই। লম্বা বসার বা কনফারেন্স টাইপের ঘর। চারদিকে সাদা সোফা। একদিকের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি, দুই পাশে পতাকা। আরেক দিকে একটি লম্বা টেবিলের এক পাশে তিনি বসে আছেন। সেদিকে এগিয়ে যেতেই বললেন, ‘কাছে এসে বসো।’ লম্বা টেবিলের দুপাশে অনেকগুলো চেয়ার। বসে ছিলেন এক কোনায়।

‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন’ বইটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলি, ‘আমার সেরা উপহারটি আপনার হাতে দিতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ।’ বললেন, ‘তুমি এসেছ, আমি খুশি হয়েছি।’ শুনে মনে হলো কত দিনের চিরচেনা আপনজন। বইটি হাত নিয়ে বললেন, ‘বইটি আমি দেখেছি। আবার পড়ব।’

এরপর পাতা ওল্টাতে থাকলেন, আর প্রশ্ন করছেন, ‘তুমি এত বছর পর কীভাবে এত মানুষকে খুঁজে বের করলে?’ আমি বলতে থাকলাম। তিনি চলে গেলেন দুঃসময়ের স্মৃতিতে। বললেন, ‘জানো, ওই দিনগুলিতে আমরা কী খেতাম আর কীভাবে যে সময়গুলি কাটত!’

জিজ্ঞাসা করলেন কার্লসরুয়ের ড. বলবীর গোয়েলের কথা। বলি, উনার কাছে তো ওয়াজেদ মিয়া একটা স্টিলের ট্রাংক রেখে এসেছিলেন। বললেন, ‘ট্রাংকে কী ছিল! সেটা এখন কোথায়?’ বললাম, পরে সেটি দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বলেন, ‘দেখো, আমি এসব কিছুই জানতে পারিনি।’

জানতে চান এলিজাবেথ নিসের কথা। ১৯৭৫ সালে জার্মানি ছেড়ে যাওয়ার আগে লেকচারার অতিথি ভবনে তিনি ছিলেন, এলিজাবেথ নিস ছিলেন সেই হাউসের প্রাধ্যক্ষ। হঠাৎ একটি ছবিতে তাঁর চোখ আটকে গেল। বললেন, ‘এই সেই গাড়ি! এটাতেই আমরা বেলজিয়াম সীমান্ত থেকে জার্মানির বন শহরে আসি।’

জার্মানির দ্য ভেল্ট পত্রিকার সাংবাদিক উলরিশ লুকের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘উনি আমাদের নিয়ে কী লিখেছিল!’ আমি বলি, ‘বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়ির দোতলা থেকে সবুজ রঙের হলুদ পাড়ের শাড়ি পরে নামছিলেন। বাঁ হাতে ছিল সাদা রুমাল, তা দিয়ে চোখ মুছছিলেন। পেছনে পেছনে নেমে এসেছিলেন আপনার ছোট বোন শেখ রেহানা। তিনিও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। ড্রয়িংরুমের খয়েরি রঙের সোফায় বসে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।’

হঠাৎ দেখি প্রধানমন্ত্রীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।

বইটির ৯১ পৃষ্ঠা দেখতে বললাম। সেখানে আছে শেখ রেহানার অন্তরের আবেগময় কষ্টের আঁকিবুঁকি। পাতাটা দেখে ছলছল চোখে বললেন, ‘এটা রেহানাকে দেখাব।’ আমি বললাম, আমি উনার জন্যও একটি বই এনেছি। বইটি বের করতেই আমার হাত থেকে বইটি টেনে নিলেন। মনে হলো, মানসপটের করুণ স্মৃতিগুলো তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে। আমিও বেদনার্ত হলাম।

এর মধ্যে একজন এসে তাগাদা দিলেন, যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত সংসদে যাবেন। উনি বইটির শেষ ফ্ল্যাপে আমার পরিচয়টি পড়লেন। বিদায়ের আগে বললাম, ‘আপা, ছবি তুলব।’ প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র ফটোগ্রাফার এস এম গোর্কি এলেন।

বললাম, ‘বঙ্গবন্ধুর ছবিটির সামনে দাঁড়াব।’ তিনি চেয়ার থেকে উঠে এলেন। আমার হাতে একটি বই দিয়ে বললেন, ‘তুমিও একটি বই হাতে নাও।’ বললাম কালই জার্মানি ফিরে যাব। আমার সৌভাগ্য দেখা হয়ে গেল। হেসে বললেন, ‘তাই নাকি।’ টানা পঁয়ত্রিশ মিনিট কেমন করে চলে গেল বুঝতে পারিনি। ফিরে এলাম একবুক ভালো লাগা নিয়ে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
    হ্যানোভার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪