‘১৯১৪ সালে নেতারা ছিলেন স্লিপওয়াকার (আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় হাঁটা ব্যক্তি)। তাঁরা ছিলেন সজাগ অথচ দেখতে অক্ষম তথা স্বপ্নগ্রস্ত। পৃথিবীতে যে ভয়াবহতা তাঁরা নামিয়ে আনতে যাচ্ছিলেন, তার বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন একেবারে অন্ধ।’
ইতিহাসবেত্তা ক্রিস্টোফার ক্লার্কের লেখা স্লিপওয়াকারস বইয়ে এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নের কাহিনি বিধৃত হয়েছে।
এই বইয়ে ক্লার্ক তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদ এবং মস্তিষ্কবিকৃতিপ্রসূত একটি বহু মেরুর বিশ্বের নকশা এঁকেছেন এবং তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দায় কোনো একক শক্তির ওপর চাপানো থেকে বিরত থেকেছেন। তার বদলে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে রাজনৈতিক নেতারা শান্তির সুবিস্তীর্ণ সম্ভাবনাকে একলহমায় একটি ভুল পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকুচিত করে ফেলেছিলেন এবং কীভাবে এক ভয়ানক বৈশ্বিক বিপর্যয়ের দিকে তাঁরা ভূতগ্রস্তের মতো হেঁটে (স্লিপওয়াকিং) গিয়েছিলেন, যার ফল হিসেবে প্রায় দুই কোটি লোককে মরতে হয়েছিল।
‘যুদ্ধই একমাত্র সমাধান’—এই বিশ্বাসে নিজেদের অটল রাখতে গিয়ে আজ আরও একবার আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সংকটের পর সংকটের মধ্য দিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছেন। তবে সে সময়কার নেতাদের সঙ্গে আজকের নেতাদের প্রধান পার্থক্য হলো, এই সময়ের নেতারা ভূতগ্রস্ত হয়ে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছেন না। তাঁরা যা করছেন, তা চোখ মেলেই করছেন।
কয়েক মাস ধরে আমরা লাখ লাখ মানুষ গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য বিক্ষোভ করছি। আমরা বিক্ষোভ করছি, যাতে করে প্রাণহানি বন্ধ করা যায় ও সহিংসতার চিরস্থায়ী চক্রের অবসান ঘটে। কিন্তু আমাদের পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের অপদস্থ করা হয়েছে। আমাদের চরিত্র হনন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দ্রুত সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যেই গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
এখন বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ব চালানো বড় বড় শক্তি যদি এই লড়াইয়ে নিজেদের না–ও জড়ায়, তাহলেও ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধের মানবিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত পরিণতি সমগ্র বিশ্বের জন্য বিপর্যয়কর ডেকে আনবে।
গাজায় শত শত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যারা এই হামলা থেকে বেঁচে আছে, তারা আজীবন মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাবে। এটি একটি আতঙ্কগ্রস্ত প্রজন্মের জন্ম দেবে। তাদের কারও কারও আশপাশের এলাকা সম্পূর্ণ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। চারদিকে মৃতদেহ ও ছিন্ন ভিন্ন দেহাবশেষের দৃশ্য চোখে নিয়ে তাদের জীবন কাটাতে হবে। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চালানো এই গণহত্যা যদি ইতিমধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি না করে থাকে, তাহলে আর কী কী হলে সেই পরিস্থিতিকে নিকৃষ্টতম বিপর্যয় বলা যাবে?
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে যে নিকৃষ্টতম দুর্দশা দেখতে হবে, তা বোঝার জন্য আলাদা করে আমাদের কল্পনা করতে হবে না। কারণ, ১৪ এপ্রিল ইরানের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল কী পদক্ষেপ নেবে, তা যখন ইসরায়েল বিবেচনা করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেও তারা গাজায় অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা ফেলছিল।
কয়েক মাস ধরে মনুষ্য সমাজ এমন এক মাত্রার ভয়াবহতা সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে, যা আমাদের চিরকাল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। গাজায় শত শত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যারা এই হামলা থেকে বেঁচে আছে, তারা আজীবন মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাবে। এটি একটি আতঙ্কগ্রস্ত প্রজন্মের জন্ম দেবে। তাদের কারও কারও আশপাশের এলাকা সম্পূর্ণ শ্মশানে পরিণত হয়েছে।
চারদিকে মৃতদেহ ও ছিন্ন ভিন্ন দেহাবশেষের দৃশ্য চোখে নিয়ে তাদের জীবন কাটাতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ বা অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই চিকিৎসকদের আহত ব্যক্তিদের দেহে অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে শিশুরা মাটির কচু–কন্দ ও লতাপাতা জোগাড় করছে এবং তা খাচ্ছে। গবাদিপশুর খাদ্য দিয়ে তারা ‘রুটি’ বানিয়ে খেতে বাধ্য হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চালানো এই গণহত্যা যদি ইতিমধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি না করে থাকে, তাহলে আর কী কী হলে সেই পরিস্থিতিকে নিকৃষ্টতম বিপর্যয় বলা যাবে? গত অক্টোবরে আমাদের মধ্যে অনেকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, আমরা গাজা ও গাজার জনগণের সম্পূর্ণ ধ্বংসের সূচনা দেখতে পাচ্ছি। আমরা উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের সবার চোখের সামনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করতে বলেছিলাম।
আজ এত দিন পর এসে কোনো কোনো রাজনীতিবিদ তাঁদের নিজেদের পাতানো অমানবিক কর্মকাণ্ডের পরিণতি দেখে ভীত হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছেন। তাঁদের যদি সত্যিকার অর্থে কোনো সততা থাকত, তাহলে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে নিহত ৩৩ হাজার ফিলিস্তিনি এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ও অনাহারে থাকা লাখ লাখ নির্দোষ ফিলিস্তিনির জন্য অশ্রুপাত করতেন।
মানবতার বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ সম্পর্কে আজ পাঠ্যবইয়ে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের শেখানো হয়। অতীতের এই ধরনের অপরাধগুলো কীভাবে ঘটতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে বলা হয়। সেসব বই থেকে শিক্ষার্থীরা সেই রাজনীতিকদের নাম শিখছে, যাঁরা নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বা তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ইতিহাসের বই আজকের সেই নেতাদের ছি ছি করবে, যাঁদের হাতে এই গণহত্যা বন্ধ করার সুযোগ ছিল; কিন্তু তারা তা না করে উল্টো যুদ্ধে নেমে উল্লাস করার পথ বেছে নিয়েছেন।
ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জীবনকে সমানভাবে দেখতে পারা এবং সে অনুযায়ী উভয়ের সঙ্গে ন্যায়ানুগ আচরণ প্রদর্শনের অক্ষমতার জন্য তাঁরা ‘অমর’ হয়ে থাকবেন। গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য তাঁরা ‘স্মরণীয়’ হয়ে থাকবেন।
আমাদের এমন রাজনীতিবিদের প্রয়োজন, যাঁদের সত্যিকার অর্থে উত্তেজনা প্রশমন ও কূটনীতিকে সহজতর করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা আছে। কিন্তু তার বদলে তাঁদের যুদ্ধের তৃষ্ণা আমাদের সবার জীবনকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
আমাদের সরকার (যুক্তরাজ্য সরকার) লড়াইয়ের শুরুতেই উভয় পক্ষকে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানাতে পারত। তার বদলে তারা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা শুরু করেছে এবং ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি দ্বিগুণ করার নীতি নিয়েছে। এর প্রতিবাদে আগামী শনিবার আবারও আমরা লন্ডনে ফিলিস্তিনিদের জন্য সমাবেশ করব।
আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রচণ্ড বাধার মুখে মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের সারাটা জীবন পার করে দিয়েছি। আমাদের সমালোচকেরাও এটা জানেন। আসলে তাঁরা আমাদের বিরোধিতা করছেন না; তাঁরা আদতে সবার জন্য অধিকতর সমান, টেকসই ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার আমাদের যে ইচ্ছা, তার বিরোধিতা করছেন।
● জেরেমি করবিন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের স্বতন্ত্র এমপি ও লেবার পার্টির সাবেক নেতা
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ