মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধের ক্লান্তি জেঁকে বসেছে কি পশ্চিমে

ভলোদিমির জেলেনস্কি
ছবি : রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়া সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর প্রায় ৬০০ দিন পেরিয়ে গেছে। এই যুদ্ধ কার কত সহনশীলতা, সেই পরীক্ষায় ফেলেছে। একই সঙ্গে ইউক্রেনকে সমর্থন জোগানো পশ্চিমাদেরও পরীক্ষায় ফেলেছে এই যুদ্ধ।

বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর। সফরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এ ছাড়া ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থনের ব্যাপারে ইউরোপে উত্তেজনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

এ মুহূর্তে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণ চলমান। সম্ভবত তীব্রতাও বেড়েছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেনকে যত দিন প্রয়োজন, তত দিন সমর্থন দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের ব্যাপারে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল। সম্প্রতি তাতে গুরুতর ফাটল সৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

জেলেনস্কির উত্তর আমেরিকা সফর শুরু হয় নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে। বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে তিনি আবেগঘন ভাষায় আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখা এবং তাঁর দেশকে সমর্থন দেওয়ার আবেদন জানান।

সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে দেশগুলো বড় ধরনের সমর্থন দিলেও যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, সেই প্রশ্নে তাদের মধ্যে অস্পষ্টতা আছে।

এ ক্ষেত্রে দুটি শিবির রয়েছে। পশ্চিমা নেতাদের অনেকে ইউক্রেন সরকারের অবস্থানকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে যতটা ভূমি দখল করে নিয়েছে, তার পুরোটাই ফেরত পেতে হবে। অন্যরা (এর মধ্যে বৈশ্বিক দক্ষিণের অসংখ্য দেশ আছে) দুই পক্ষের সংলাপ এবং সহিংসতার সমাপ্তি চান।

একই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পেলাম জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উন্মুক্ত বিতর্কের সময়ে। জেলোনস্কি ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের মধ্যে যে তুমুল বিতর্ক হবে, সেটা অনুমেয় ছিল। কেননা, যুদ্ধের গতিধারা নিয়ে দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটাই আলাদা।

কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক শেষ হওয়ার আগেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল নাগোরনো-কারাবাখ সংকটের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিতই দেওয়া হয়, ইউক্রেনই একমাত্র জরুরি বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডা নয়।

নিউইয়র্ক থেকে জেলেনস্কি ওয়াশিংটনে যান। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও ৩২৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করেন। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের ক্ষমতাবলে যে অর্থ বরাদ্দ দিতে পারেন, সেখান থেকে এই সহযোগিতার জোগান আসতে পারে। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য ২৪ বিলিয়ন ডলারের যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, সেটা দিতে গেলে কংগ্রেসের অনুমতি প্রয়োজন। রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে প্রতিনিধি পরিষদের নেতা কেভিন ম্যাকার্থি এ বছর শেষ হওয়ার আগে এ-সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করবেন বলে মনে হয় না।

প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের যৌথ অধিবেশনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ভাষণ দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন ম্যাকার্থি। এ ঘটনা এই লক্ষণ প্রকাশ করছে যে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের যে উৎসাহ, তাতে ভাটা দিতে রিপাবলিকানদের মধ্যে প্রতিরোধ বাড়ছে।

জেলেনস্কি ও তাঁর নীতির ওপর খোলাখুলি আক্রমণ ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের তাক লাগানো ভাবমূর্তিকে খাটো করছে। পশ্চিমা বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও খরচ নিয়ে যখন অস্বস্তি বাড়ছে, ঠিক তখনই জেলেনস্কিকে নিয়ে এই সমালোচনা হচ্ছে।

কানাডা সফরে গিয়ে জেলেনস্কি দলনিরপেক্ষভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। ইউক্রেনকে নতুন করে ৪৮২ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক সাহায্য দিচ্ছে কানাডা।

এদিকে ইউরোপে কিয়েভের তিন প্রতিবেশী—হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া—ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। পোল্যান্ড আরও এক ধাপ বাড়িয়ে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে। এ ঘটনাকে জেলেনস্কি ‘রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ’ বলে সমালোচনা করে বলেছেন, এটা মস্কোর জন্য উপহার।  

পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্য নিয়ে বিতর্ক কয়েকবার উসকে উঠেছিল। এ নিয়ে উত্তেজনা কখন তুঙ্গে উঠবে, সেটাই ছিল প্রশ্ন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পথে আরও অন্য বিষয়ের সঙ্গে এটিও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের নিজেদেরই কিছু সক্ষমতা রয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উরসুলা ভন ডের লেন তাঁর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাৎসরিক ভাষণে যার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সক্ষমতার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকার (ইউরোপীয় ইউনিয়ন)’। তিনি স্বীকার করেন, ‘এর মধ্যেই ইউক্রেন বড় অগ্রগতি দেখিয়েছে।’

যা-ই হোক, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে দর-কষাকষির সুযোগ এ-সংক্রান্ত গঠিত কমিটির ইতিবাচক সুপারিশের আগপর্যন্ত শুরু হবে না। ২০২২ সালের জুনে ইউক্রেনকে প্রার্থী সদস্যের মর্যাদা দেওয়ার সময় সাতটি শর্ত দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ বছরের শেষ নাগাদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

দর-কষাকষির আলোচনা শুরু হলে ইউক্রেনের সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলো অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। পোল্যান্ডের সঙ্গে চলমান বিভক্তি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইউক্রেনের সামনে বড় বাধা অপেক্ষা করছে। যদিও ইউরোপীয় কমিশনের কৃষি নীতির কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ের কারণে এমনিতেই ইউক্রেনের সদস্যপদ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি খুব পরিষ্কারভাবে ইউক্রেনীয় রপ্তানিকারকদের হাত থেকে তাঁর দেশের কৃষকদের রক্ষা করতে চান। কেননা, ইউক্রেনীয় রপ্তানিকারকেরা প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় অভ্যস্ত নন।

ইউক্রেন ইইউর সদস্যপদ পেলে পোল্যান্ডের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। পূর্ব ইউরোপের সদস্যদেশগুলোর মোড়ল হিসেবে থাকতে চায় তারা।

জেলেনস্কি ও তাঁর নীতির ওপর খোলাখুলি আক্রমণ ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের তাক লাগানো ভাবমূর্তিকে খাটো করছে। পশ্চিমা বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও খরচ নিয়ে যখন অস্বস্তি বাড়ছে, ঠিক তখনই জেলেনস্কিকে নিয়ে এই সমালোচনা হচ্ছে।

এটা বলা যাবে না যে ইউক্রেন চলমান পাল্টা অভিযানে থেকে অগ্রগতি অর্জন করেনি। সর্বসম্প্রতি, দক্ষিণাঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনী অর্জন পেয়েছে। ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর নৌবহরের সদর দপ্তরে হামলা চালাতে সক্ষম হয় তারা।

কিন্তু এই যুদ্ধে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এ ধরনের ছোটখাটো অর্জন তেমন কোনো অর্থ বহন করে না। এখন পর্যন্ত পশ্চিমা সহযোগিতা ইউক্রেনকে প্রতিরক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনের জয় নিশ্চিতের জন্য সেটা যথেষ্ট নয়।

  • স্টিফেন উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার অধ্যাপক

  • তিতেনা মালিয়ারেনকা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ওদেসা ল একাডেমির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক