মতামত

যে ওসিরা মার্কা বলে ভোট চান তাঁদের দিয়ে ‘শুদ্ধ’ নির্বাচন!

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের বৈশিষ্ট্য হলো তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন এবং উত্তর দেন। কী কী করলে সুষ্ঠু ও শুদ্ধ নির্বাচন হতে পারে, শুরু থেকে আমরা তার বয়ান শুনে এসেছি।

গত শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষকদের (বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা) প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনকালে সিইসি বলেছেন, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নেই। তবে নির্বাচনের পর নির্বাচনের শুদ্ধতা (ভোট কেমন হলো) নিয়ে জনমনে যে ধারণার তৈরি হয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অনুষ্ঠানে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সুন্দরভাবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে পারলে সেটা হবে সার্থকতা। এর সঙ্গে আরও বিশেষণ যুক্ত হয়েছে—অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে যে বিষয়গুলো ঘুরেফিরে এসেছে, সেগুলো হলো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচন। সুন্দর নির্বাচন। নিরপেক্ষ নির্বাচন। শুদ্ধ নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এর মধ্যে তিনি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন নির্বাচনের শুদ্ধতা সম্পর্কে জনমনে ধারণাকে।

সংসদ বাংলা অভিধানে শুদ্ধ শব্দের অর্থ হলো: ১. নির্দোষ ২. নির্মল ৩. পবিত্র ৪. শুচি ৫. শোধিত ৬. খাঁটি-নির্ভেজাল ৭. নির্ভুল।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তিনটি (১৯৭৩,২০১৪ ও ২০১৮)। বিএনপি সরকারের অধীনে দুটি (১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি)। এরশাদ সরকারের আমলে দুটি ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে। এগুলোর কোনোটি দলীয় সরকারের অধীনে, কোনোটি সামরিক সরকারের অধীনে হয়েছে। ফলে এ নির্বাচনগুলো শুদ্ধতা হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। এর কোনোটি একতরফা, কোনোটি জবরদস্তিমূলক হয়েছে।

সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে আছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে যেই রূপ কর্মচারী প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন আরজি করলে রাষ্ট্রপতি সেই রূপ কমিশন প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন। কিন্তু ২০১৮ এর নির্বাচনে উল্টোটাই ঘটেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেই রূপ চেয়েছে, নির্বাচন কমিশন সেই রূপ কার্য সম্পাদন করেছেন।

অন্তত ওই সব নির্বাচনের সময় যাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন, তাঁরা এর শুদ্ধতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করেই চলেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন।

এর বাইরে চারটি নির্বাচন হয় নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যথাক্রমে ১৯৯১,১৯৯৬ সালে (১২ জুন) ২০০১ ও ২০০৮ সালে। এই নির্বাচনগুলো সম্পর্কে সিইসির ভাষায় জনমনে ধারণাটা কী? শতভাগ শুদ্ধ না হলেও মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে। দেশের মানুষ ও বিদেশের পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। বিরোধী দলও প্রথম দিকে মানি না মানব না বললেও পরে মেনে নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে, সেটি কেমন হবে? সিইসি বলেছেন, নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে যেসব দল নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে, তাদের সবার অংশগ্রহণ।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার একটিই উপায়—নির্বাচন। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি রাজনৈতিক দল বা নির্বাচন কমিশন নয়। যে তারা একটি ঘোষণা দিলেই নির্বাচনটি হয়ে যাবে। নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছে বা অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গত ৫২ বছরেও এমন কোনো পদ্ধতি বা ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারেনি, যাতে নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শুদ্ধ হতে পারে। যাঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন বা আছেন, তাঁরা ফলাফল নিজের পক্ষে আনতে নানা রকম কারসাজি করেছেন।

এ কারণেই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিটি সামনে আসে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটা আদায় করেছিলেন। অতীতে যদি কোনো দল সেই ব্যবস্থাকে নষ্ট করে, তার প্রতিকার সেটিকে বাতিল করা নয়। পরিমার্জন বা শুদ্ধ করা। নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবেই এর ফয়সালা করতে হবে।

দু-একটি বাদে পৃথিবীর সব দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। কোনো ঝামেলা হয় না। আমাদের দেশে কেন হলো, সেই প্রশ্নের উত্তরও নির্বাচন কমিশনকে খুঁজতে হবে। আমাদের মনে হয়, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী কাজে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আগে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জন্যও একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে; যাতে ওই নেতা-কর্মীরা অন্তত ভোটের আগে, ভোটের সময় এবং ভোটের পর ভোটারদের প্রতি জবরদস্তি না করেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁর সহকর্মীরাও দেবেন। এই প্রশিক্ষকেরা যাদের প্রশিক্ষণ দেবেন, তাদের মধ্যে মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা থাকবেন, থাকবেন ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তারা। আরও থাকবেন মাঠ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরাও।

তাদের মধ্যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও। কিন্তু এই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, সেটি মুছে ফেলবেন কী করে? সাম্প্রতিককালে পুলিশের অন্তত তিনজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট চেয়েছেন আগামী নির্বাচনে। যেসব কর্মকর্তা প্রকাশ্যে কোনো দলের পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চান, তাদের নিয়ে শুদ্ধ নির্বাচন করবেন কীভাবে নির্বাচন কমিশন?

যারা প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের না হয় কমিশন চিহ্নিত করতে পারল। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেননি, তাদের কীভাবে ধরবেন। অথবা যারা ধরবেন, তারাও যদি একই মানসিকতা পোষণ করেন, তাহলে কী হবে।

নির্বাচন কমিশন কি সত্যি সত্যি একটি শুদ্ধ নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছে। যদি থাকে তাহলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে আছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে যেই রূপ কর্মচারী প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন আরজি করলে রাষ্ট্রপতি সেই রূপ কমিশন প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন। কিন্তু ২০১৮ এর নির্বাচনে উল্টোটাই ঘটেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেই রূপ চেয়েছে, নির্বাচন কমিশন সেই রূপ কার্য সম্পাদন করেছেন।

এই কর্মসংস্কৃতি বদলাতে না পারলে সিইসির শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com